উড়িষ্যার মন্দির বলতেই প্রথমে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির। পুরী বেড়াতে গিয়ে জগন্নাথদেবের মন্দির দর্শন করেননি, এমন বাঙালী খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। শুধু জগন্নাথ মন্দির নয়, উড়িষ্যায় আরও প্রচুর ছোট বড় মন্দির রয়েছে। যার মধ্যে তুলনাহীন যেমন ভাস্কর্য্য রয়েছে, তেমনই রয়েছে ইতিহাসও। যেমন পুরী জেলার কোনার্ক সূর্য মন্দির। সেখানে কোন পূজোর ব্যবস্থা চালু না থাকলেও ভাস্কর্য্যের দিক থেকে এই মন্দির সারা ভারতে বিখ্যাত।
বিশ্বাস করা হয় যে, মন্দিরটি ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের প্রথম নরসিংহদেব মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। মন্দির কমপ্লেক্সটি একটি বিশাল রথের আকৃতিতে (সূক্ষ্ম কারুকার্যময় পাথরের চাকা, স্তম্ভ ও দেওয়াল সহ) তৈরি করা হয়েছে। কাঠামোর একটি প্রধান অংশ এখন ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান মন্দিরটি পুরী থেকে ৩৫ কিমি এবং ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিমি দূরে অবস্থিত।
কোণার্ক নামটি সংস্কৃত শব্দ কোনা বা কোণ এবং অর্ক (সূর্য) শব্দদুটি মিলিয়ে তৈরি। যা মন্দিরের উল্লেখিত সৌর জগতের দেবতা সূর্যকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। অর্থাৎ সূর্যের বিভিন্ন কোণের অবস্থান। এই মন্দিরটি সূর্যের বিভিন্ন অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে।
স্মৃতিস্তম্ভটিকে ইউরোপীয় নাবিকরা ব্ল্যক প্যাগোডা নামেও অভিহিত করতো। এর অন্যদিকে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরটকে বলা হতো হোয়াইট প্যাগোডা।
দুই মন্দিরই নাবিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হতো। কোণার্ক সূর্য মন্দিরের পরিকাঠামোর জন্য লোহার বিম ব্যবহৃত হয়েছিল।
মন্দির গড়ে ওঠার পেছনে দুটি মত আছে। প্রথমত, পূর্বগঙ্গ রাজবংশের (১০৭৮- ১৪৩৪) নরসিংহদেব (১২৩৮ - ১২৬৪ খ্রিষ্টাব্দ) ১২৩২ - ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বাংলা জয়ের স্মারকরূপে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে প্রাচীন মিত্রাবনে অর্থাৎ আজকের কোনারকে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয়ত, পুরাণ মতে শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব রূপে অত্যন্ত নয়নভোলানো ছিলেন। সব মহিলাদের নজর কাড়তেন। শাম্ব একদিন নারদের ডাকে সাড়া দিতে ভুলে গেলে নারদের মনে প্রতিশোধস্পৃহা জাগে। একদিন কৃষ্ণ যখন গোপিনীদের সঙ্গে লীলায় ব্যস্ত তখন নারদের মন্ত্রনায় শাম্ব সেখানে ঢুকে পড়ে। সেইসময় গোপিনীদের নজর তার ওপর গিয়ে পড়ে। তখন কৃষ্ণ প্রচুর রেগে গিয়ে তাকে অভিশাপ দানের প্রয়োজনে শাস্তি দেন যে তার রূপ হারিয়ে যাবে। তখন মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে সে কোনারকে সমুদ্রের তীরে এসে সূর্যদেবকে কঠোর তপস্যায় মুগ্ধ করে নিজের হারানো রূপ ফিরে পেয়ে সমুদ্রতীরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
মন্দিরে সূর্যদেবতার যে বিশাল বিগ্রহ ছিল তা এখন নেই। কালের করাল গ্রাসে স্থাপনার অনেকটাই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এর কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, বাংলার সুলতান সুলায়মান খান করনানির সেনাপতি কালাপাহাড়ের আক্রমণে কোনার্ক মন্দির প্রথম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। উড়িষ্যার ইতিহাস অনুযায়ী, কালাপাহাড় ১৫০৮ সালে কোনার্ক আক্রমণ করে। দ্বিতীয়ত, নরসিংহদেব মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে বহিস্কৃত হয়। তাই তিনি নিজে মন্দির ধ্বংস করেন। তৃতীয়ত, ১৬২৬ সালে খুরদার তৎকালীন রাজা পুরুষোত্তমদেবের পুত্র নরশিমাদেব সূর্যদেবের বিগ্রহটি পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে নিয়ে যান। সেখানে একটি পৃথক মন্দিরে সূর্য ও চন্দ্রদেবতার বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। শুধু বিগ্রহই নয় তিনি কোনার্ক মন্দির থেকে কারুকার্য করা অনেক পাথর পুরীর মন্দিরে নিয়ে যান। এমনকি নবগ্রহ পথ নামে একটি বিশাল প্রস্তর খন্ডও তিনি পুরীতে নিয়ে যান। মারাঠা শাসন আমলে কোনার্ক মন্দির থেকে অনেক ভাস্কর্য ও প্রস্তরখন্ড পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৭৭৯ সালে কোনার্ক থেকে অরুণ কুম্ভ নামে বিশাল একটি স্তম্ভ নিয়ে পুরীর সিংহদ্বারের সামনে স্থাপন করা হয়। এই সময় মারাঠা প্রশাসন কোনার্কের নাট মন্ডপটি অপ্রয়োজনীয় মনে করে ভেঙ্গে ফেলে। সূর্যদেবের বিগ্রহ অপসারণের পর কোনার্কে পূজা ও আরতি বন্ধ হয়ে যায়। চতুর্থত,পর্তুগীজ জলদস্যুদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে কোনার্ক বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়। পর্তুগীজ জলদস্যুদের দস্যুবৃত্তি করতে অসুবিধা হওয়ার জন্য পর্তুগীজ দস্যুরা কোনার্ক মন্দিরের মাথায় অবস্হিত অতি শক্তিশালি চুম্বকটিকে নষ্ট করে দেয়।
আঠারশো শতক নাগাদ কোনার্ক মন্দির তার সকল গৌরব হারিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। মন্দিরের অনেক অংশ বালির নিচে চাপা পড়ে যায়। মন্দির চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকা ধীরে ধীরে ঘন অরণ্যে ছেয়ে যায়। বুনো জন্তুরা বাসা বাঁধে মন্দিরের ভিতর। জলদস্যু ও ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয় কোনার্ক মন্দির। সেসময় দিনের আলোতেও সাধারণ মানুষ ভয়ে এর ত্রিসীমানায় যেত না।
আজও ভোরের সূর্যোদয়ের প্রথম আলো মন্দিরের প্রাঙ্গনে এসে পড়ে। মন্দিরের ভাস্কর্য অনুপম। বেদী থেকে শুরু করে চূড়া পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গায় পাথরের ভাস্কর্য ও কারুকার্য রয়েছে। দেবতা,অপ্সরা, কিন্নর, যক্ষ, গন্ধর্ব, নাগ, মানুষ, বালিকা বধূ বিয়ের শোভাযাত্রা, রাজার যুদ্ধ প্রস্তুতি, মৃদঙ্গকরতাল বীণা, মোহিনী, মিঠুন মূর্তি, ছয় হাতের শিব, রাজদরবারের নানান দৃশ্য, পৌরাণিক বিভিন্ন ঘটনার প্রতিরূপ, নৃত্যরত নরনারী, প্রেমিক যুগল, ফাঁদ দিয়ে হাতি ধরা, শিকারের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাথরের বুকে। মূর্তিগুলোর মানবিক আবেদন, নিখুঁত গড়ন,লীলায়িত ভঙ্গী শিল্পকলার চরম উত্কর্ষের নিদর্শন। মন্দিরের দরজায় মানুষের মূর্তি শায়িত। সিংহ শক্তি অর্থাৎ ক্ষমতার প্রতীক এবং হাতি কিংবা সম্পদের প্রতীক এদের মাঝে পিষে মরছে মানুষ।
বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতত্ববিদরা কোনার্ক মন্দির পুনঃরাবিষ্কার করেন। ৩০০ বছর ধরে বালিরস্তূপের নিচে অনাদর ও অবহেলায় পড়ে থাকা এই সূর্য মন্দিরটিকে ১৯০৪ সালে বড়লাট লর্ড কার্জন উদ্ধার করেন৷ তবে তারও আগে কোন বিপর্যয়ের কারনে মূল সূর্য মন্দিরটি অবুলুপ্ত হয়। আমরা যেটাকে মন্দির হিসেবে দেখি সেটা আসলে নাট মন্দির, মূল মন্দির নয়৷ ফলে লোকচক্ষুর সামনে উন্মোচিত হয় কোনার্ক মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী, বিস্ময়কর ভাস্কর্যকীর্তি ও অনন্য শিল্প সম্ভার। কোনার্ক মন্দিরের অনেক শিল্পকীর্তি এখন সূর্য মন্দির জাদুঘর ও উড়িষ্যার জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী কোনার্কের সূর্য মন্দির দেখতে আসেন। প্রাচীন ভারতীয় স্থপতি ও ভাস্করদের শিল্পনৈপুণ্য ও সৃষ্টিশীলতা আজও মানুষকে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ করে।
উড়িষ্যার অন্যতম বিখ্যাত পরশুরামেশ্বর মন্দির রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বরে অবস্থিত। এটিকে ৭ম ও ৮ম শতকের মধ্যবর্তী শৈলোদ্ভব যুগের প্রাচীন ওড়িশিয় হিন্দু মন্দিরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সংরক্ষিত মন্দির হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি হিন্দু দেবতা শিব এর মন্দির যা উড়িষ্যা রাজ্যের প্রাচীন মন্দিরগুলোর একটি। এটি ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে নাগারা স্থাপত্যে নির্মিত বলে মনে করা হয়। মন্দিরটি দশম শতকের পূর্ববর্তী সময়ের সকল বৈশিষ্ট্য বহন
এই মন্দিরে একটি বিমান এবং একটি সমতলীয় প্রার্থনাস্থান রয়েছে। গোলাকার লম্বাটে উঁচু চূড়াটি ৪০.২৫ ফুট উঁচু, যাকে ‘বিমান’ বলা হয়। এটিই প্রথম মন্দির যার বিমান ছাড়াও ‘জগমোহন’ নামের আরেকটি নির্মিতি রয়েছে, যদিও অনেক মন্দির কেবল বিমান থাকে। শিবের মন্দির হলেও এতে শাক্তদের বিভিন্ন ছবি দেখা যায়, যা বিভিন্ন শাক্ত মন্দিরে থাকে। আষাঢ় মাসের পরশুরামাষ্টমীতে এ মন্দিরে উদযাপিত সবচেয়ে বড় উৎসব। উড়িষ্যা রাজ্যের পর্যটকদের কাছে মন্দিরটি একটি বিশেষ আকর্ষণ।
উড়িষ্যার মন্দিরগুলোয় দুটি অংশ থাকে- বিমান এবং জগমোহন। পরশুরামেশ্বর মন্দিরই প্রথম মন্দির যার এই দুটি অংশ রয়েছে। এর আগের মন্দিরগুলোতে জগমোহন অংশটি ছিল না এবং পরবর্তী সময়ের মন্দিরগুলোতে ‘নাটমণ্ডপ’ এবং ‘ভোগমণ্ডপ’ নামে দুটি অতিরিক্ত অংশ যুক্ত হতে দেখা যায়। বিমানটি বর্গাকার, দেয়ালগুলো বিভিন্ন আকৃতির। এর ভিতরের জায়গার পরিমাপ ৯.৮৮ফুট বাই ৯.৭৫ ফুট এবং বাইরে থেকে ২৯.৩৩ ফুটঁ বাই ২১ ফুট। উচ্চতা ৪০.২৫ ফুট। অমলক নামের একটি পাথরের গোলাকার চাকতি এর শিখরে অবস্থিত।
জগমোহন আয়তাকার এবং দুই সারি আনত ছাদ সংবলিত। জগমোহনের মাপ ভিতর থেকে ২৪.৯৪ ফুট বাই ১৩.৩৩ ফুট এবং বাইরে থেকে ২৯.৩৩ ফুট বাই ২৮.৫৮ ফুট। পাতাজালি ধরনের জানালাগুলো বর্গাকার এবং আয়তাকার। পাথরে বিভিন্ন নৃত্যশিল্পী এবং সঙ্গীতশিল্পীর ছবি খোদাই করা আছে। দরজা আর জানালাগুলো দিয়ে মন্দিরে আলো প্রবেশ করে। বিমান এবং জগমোহনের সংযোগস্থলটি পূর্ণরূপে নির্মিত নয়, তাই অনেকে মনে করেন একটি অংশ অনেক পরে নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। তবে প্রাচীন সময়ে এ সংযুক্তি ভবনের সাথে নির্মিত হওয়া অসম্ভব ছিল না। ভারী প্রস্তরখণ্ড মাটিতে প্রোথিত করে মন্দিরটি বানানো হয়েছে। এই মন্দিরটি ভুবনেশ্বরের মুক্তেশ্বর, লিঙ্গরাজ, রাজারাণী এবং কোনারকের সূর্যমন্দিরের মত উল্লম্ব স্থাপনার প্রাধান্যযুক্ত ‘নাগারা’ ধরনের স্থাপত্যে নির্মিত।
বিমান ও জগমোহন অংশে শিবানুচর বেতালদের ছবি আছে। এছাড়া বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাগনাগিনীদের ছবি দেখা যায়। তীর্থযাত্রা, বিমানের বহু ছবির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বিমানের অন্যান্য ছবির মধ্যে শিকারের ছবি উল্লেখযোগ্য যেমন মৃগ শিকারীর সামনে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে এমন ছবি। জগমোহনের সবচেয়ে বাইরের জানালার ফ্রেমে কিছু ক্রীড়ামত্ত বানরের ছবি আছে। বিমানটি পঞ্চরথ মনে হলেও এটি মূলত ত্রিধর প্রকৃতির (চূড়ার উপরের প্রস্থচ্ছেদে চৌদিকে তিনটি ভাঁজ)। বিমানের চূড়াটি নিচ থেকে শুরু করে তিনটি খাজ নিয়ে ঘনক আকৃতির পরিবর্তে আয়তাকার ভাবে উপরে এসে মিলেছে।
লিঙ্গরাজ মন্দির পূর্বভারতীয় রাজ্য উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে অবস্থিত প্রাচীন মন্দির গুলোর মধ্যে অন্যতম। মন্দিরটি শিব এবং বিষ্ণুর মিলিত রূপ হরিহরের নামে উৎসর্গীকৃত। মন্দিরটি ভুবনেশ্বরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূস্থাপনা এবং প্রধান পর্যটন স্থান।
লিঙ্গরাজ মন্দির ভুবনেশ্বরের সব থেকে বড় মন্দির। কেন্দ্রীয় মিনারটি ১৮০ ফুট উঁচু। মন্দিরটি কলিঙ্গ স্থাপত্যকলা এবং মধ্যযুগীয় ভুবনেশ্বর স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। ধারণা করা হয়ে থাকে মন্দিরটি সোমবংশী রাজত্বকালে নির্মিত যা পরবর্তীতে গঙ্গা শাসকদের হাতে বিকশিত হয়। মন্দিরটি দেউল শৈলীতে নির্মিত যার চারটি ভাগ আছে। সেগুলো হচ্ছে বিমান, জগমোহন, নাট্যমন্দির এবং ভোগমন্ডপ। ভাগগুলোর উচ্চতা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। মন্দির চত্ত্বরটি দেয়ালঘেরা।
ভুবনেশ্বরকে একাম্রা ক্ষেত্র বলা হয়ে থাকে। লিঙ্গরাজ মন্দিরটি মন্দির ট্রাস্ট বোর্ড এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার অধীনে পরিচালিত হয়। প্রতিদিন গড়ে ৬০০০ দর্শনার্থী মন্দিরটি দেখতে আসে এবং উৎসব সিজেনে লক্ষাধিক ভ্রমণার্থী আসে। এখানকার শিবরাত্রি উৎসব প্রধান অনুষ্ঠান এবং ২০১২ সালে উৎসবের আগে দু’লক্ষ দর্শনার্থী এসেছিল।
লিঙ্গরাজ শব্দের আক্ষরিক অর্থ লিঙ্গের রাজা, হিন্দুমতে শিবের প্রতিরূপ। আদিতে শিবকে কীর্তিভাসা এবং পরে হরিহর হিসেবে পূজা করা হতো। তাকে ত্রিভুবনেশ্বর (ভুবনেশ্বরও বলা হয়) বলা হয় যার অর্থ স্বর্গ, মর্ত ও শূন্যলোকের অধিপতি। তার সঙ্গিনীকে বলা হয় ভুবনেশ্বরী।
এগারো শতকের শেষ দশক থেকে মন্দিরটি এখনও টিকে আছে। ষষ্ঠ শতকে মন্দিরটি নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায় কারণ সপ্তম শতকের কিছু সংস্কৃত পুঁথিতে মন্দিরটির উল্লেখ আছে। ফার্গুনসনের মতে মন্দিরটির নির্মাণকাজ শুরু করেন ললাট ইন্দু কেশরী যিনি ৬১৫ থেকে ৬৫৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। জমায়েত স্থল জগমোহন এবং মন্দির মিনার এগারো শতকে নির্মিত হয় অন্যদিকে ভোগমন্ডপ বারো শতকে নির্মিত হয়। শালিনীর স্ত্রী ১০৯৯ থেকে ১১০৪ সালের মধ্যে নটমন্দির নির্মাণ। এই অঞ্চলে জগন্নাথ অংশ বাড়তে থাকলে মন্দিরটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় বলে ধারণা করা হয়। গঙ্গা শাসকেরা বৈষ্ণবধর্মের অনুসারী ছিলো এবং ১২ শতকে পুরিতে তারা জগন্নাথ মন্দির স্থাপন। তবে কিছু মতে মন্দিরটি ১১ শতকের মধ্যে নির্মান করেন সোমবংশী রাজা যযাতি। যযাতি কেশরী তার রাজধানী জাজপুর থেকে ভুবনেশ্বরে সরিয়ে আনে যাকে ব্রাহ্মপুরাণে একাম্রাক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সোমভামসি রাণীদের একজন মন্দিরটিকে একটি গ্রাম দান করেন এবং মন্দিরের ব্রাহ্মণগণ উপযুক্ত পারিতোষিক পেতেন।
হিন্দু কিংবদন্তী অনুসারে একটি ভূগর্ভস্থ নদী লিঙ্গরাজ মন্দিরের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিন্দুসাগরে এসে পড়েছে এবং বিশ্বাস করা হয়ে থাকে এর জল দৈহিক ও আত্মিক অসুস্থতা দূর করার ক্ষমতা রাখে। পুকুরের জলকে পবিত্রজ্ঞান করা হয় এবং উৎসব মৌসুমে তীর্থযাত্রীরা এই পুকুরে পবিত্রস্নান করে থাকে। মন্দিরের প্রধান দেবতা লিঙ্গরাজকে শিব এবং বিষ্ণু উভয় হিসেবে পূজা করা হয়। হিন্দুধর্মের দুটি ধারা শৈব ও বৈষ্ণবধর্মের মিলন ঘটেছে এই মন্দিরে যেখানে বিষ্ণু ও শিবের মিলিত রূপ হরিহরকে পূজা করা হয়।
লিঙ্গরাজ মন্দিরের বাৎসরিক রথযাত্রা রুকুন রথ যাত্রা।
লিঙ্গরাজ মন্দিরের প্রধান উৎসব হচ্ছে শিবরাত্রিতে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় এবং এ সময়ে কয়েক হাজার ভক্ত মন্দির পরিদর্শনে আসে। সারাদিনের উপবাস শেষে এই শুভদিনে লিঙ্গরাজকে বেলপাতা নিবেদন করা হয়। প্রধান উদ্যাপন হয় রাতে যখন ভক্তদল সারা রাত প্রার্থনা করে। মন্দির চত্ত্বরে মহাদ্বীপ প্রজ্জ্বলনের পরর ভক্তদল তাদের উপবাস ভঙ্গ করে। প্রতিবছর শ্রাবণমাসে হাজারো তীর্থযাত্রী মহানদী নামক নদী থেকে পায়ে হেটে পানি মন্দিরে বয়ে আনেন।
চন্দন যাত্রা হচ্ছে ২২ দিনব্যাপী উৎসব যখন মন্দিরের সেবায়েতরা বিন্দুসাগরে বিশেষভাবে নির্মিত নৌকায় অবস্থান করে। দেবতা এবং সেবায়েতগণকে চন্দনবাটা মাখানো হয়। নৃত্য, একসাথে ভোজন ইত্যাদির আয়োজন করে মন্দিরসংশ্লিষ্ট জনগণ।
প্রতিবছর অশোকাষ্টমীতে লিঙ্গরাজ মন্দিরে রথ উৎসবের আয়োজন করা হয় যা রথযাত্রা নামে পরিচিত। একটি রথে চড়িয়ে দেবতাকে রামেশ্বর দেউল মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। হাজারো ভক্ত রথকে অনুসরণ করে ও রথ টানে। রথে লিঙ্গরাজ ও তার বোন রুকমনির মূর্তি থাকে।
ভুবনেশ্বরের অন্যান্য মন্দিরে পূজা অর্চনা নিয়মিত নয় কিন্তু লিঙ্গরাজ মন্দিরে নিয়মিত হয়। মন্দির অভ্যন্তরে অহিন্দুদের প্রবেশাধিকার নেই তবে মন্দিরের বাইরে নির্মিত দর্শনের বেদী থেকে দেখা যায়। দর্শনবেদীটা মন্দিরের পিছন দিকে। মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষার্থে মন্দিরে কুকুর, অস্নাত দর্শনাভিলাষী, ঋতুমতী নারী এবং যাদের পরিবারে ১২ দিনের মধ্যে জন্ম বা মৃত্যু ঘটেছে তাদের প্রবেশ নিষেধ। কোন কারণে অনাহুত প্রবেশ সংঘটিত হলে মন্দির শুদ্ধতার জন্যে বিশেষ আচারবিধি অনুসরণ করে এবং প্রসাদ একটি কূপে ফেলে দেওয়া হয়।।
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.