ভ্রমণ

ভ্রমণ

বক্সায় সবুজের অভিযান

লেখক : ডঃ চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী (প্রাক্তন উপাচার্য)

বক্সায় সবুজের অভিযান

খবরটা বারুইপুরের বোস বাড়িতে পৌঁছতেই কান্নার রোল পড়ে গেল৷ একাদশ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র সবুজ বোসের সুকল শিক্ষিকা মা কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হতে লাগলেন৷ সবুজের বাবা পোস্টমাস্টার৷ ছেলের খবর পেয়েও অফিস থেকে বেরোতে না পেরে বারে বারে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে জলের ঝাপ্ঢা দিয়ে সহকর্মীদের চোখ থেকে নিজের কান্না আড়াল করতে লাগলেন৷

পড়শিরা বোস বাড়ি এসে বলাবলি করতে লাগল--- এমন একটি প্রকৃতি পাগল প্রাণ চঞ্চল ছেলে ট্রেকিং করতে গিয়ে কী করে হারিয়ে যেতে পারে? ও তো ক্লাস এইট থেকেই নেচার ক্লাবের সদস্য হিসাবে প্রতি বছর দুবার বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পে গিয়ে সুযোগ পেলেই ট্রেকিং করে৷ এই তো গত বছর ওরা ক্যাম্প করেছিল বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে৷ ওদের ট্রেনার মহিম সরকার ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে সবুজের বাবাকে বলেছিল, ‘বোসবাবু, আপনার ছেলে বড় হয়ে একজন বড় মাপের পর্বতারোহী হবে৷ শুশুনিয়ার পাহাড়ে ট্রেকিং করে সবুজ আমাকে তাজ্জব করে দিয়েছে৷ ঐ পাহাড়ের একটা দুর্গম দেয়ালে রাজা চন্দ্রবর্মনের শিলালিপি দেখতে ট্রেকিং করে সেখানে উঠেছিল৷ সে সময়ে হঠাৎ বৃষ্টি নামায় পাহাড় খুব পিচ্ছিল হয়েছিল৷ প্রায় সন্ধ্যাবেলা সবুজ ঐ পাহাড় থেকে নেমে এসেছিল অক্ষত অবস্থায়৷’ ছেলের কান্ড শুনে অনন্ত বসু গর্ববোধ করলেও মনে মনে শঙ্কিত হয়েছিলেন৷ তাই এবার ক্যাম্প করতে যাবার আগে ছেলেকে পই পই করে বলেছিলেন, ‘‘মহিমবাবুর অনুমতি ছাড়া ক্যাম্প ছেড়ে কোথাও যাবি না৷’’ সেই ছেলে কোথায় যে গেল, তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না৷

মাত্র সাতদিন আগের কথা খ্যাতনামা পর্বতারোহী এবং প্রকৃতিপ্রেমী মহিম সরকার পুজোর ছুটিতে নেচার ক্যাম্পে যোগদানকারী বারোজন পড়ুয়ার সামনে এবারের ক্যাম্পের স্থান এবং যোগদানকারীদের করণীয় বিষয়ে বক্তব্য রাখেন৷ তিনি বলেন: ‘এবার তোমরা যে বারোজন নবম শ্রেণির এবং ছজন একাদশ শ্রেণির৷ ছটা বিদ্যালয় থেকে তোমাদের নাম পাঠানো হয়েছে৷ এবার আমরা যাচ্ছি আমাদের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরভাগের হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা জাতীয় উদ্যানের লাগোয়া সান্তালবাড়িতে৷ সেখানে ক্যাম্প করে আমরা প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য এবং জৈব বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করব৷

অরুণ নামক একজন ছাত্র বলল, ‘‘স্যার বক্সা জাতীয় উদ্যানের বিশেষত্ব কী?’
মহিম বললেন, ‘খুব ভালো প্রশ্ন করেছ অরুণ৷ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর অংশের সিঞ্চুলা পর্বতমালায় এই উদ্যানটি তৈরি হয়েছে ১৯৮৩ সালে৷ বর্তমানে এটি আলিপুরদুয়ার জেলার অন্তর্গত৷ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮০০ ফুট উচ্চতায় প্রায় ৭৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট বক্সা জাতীয় উদ্যান৷’

বক্সা জাতীয় উদ্যানের অবস্থান বোঝানোর জন্য মহিমবাবু ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে একটা ম্যাপের মতো এঁকে বললেন, ‘‘দেশ এই উদ্যানের উত্তর অংশে সিঞ্চুলা পর্বতমালা, এর ওপারে আছে ভুটানের ফিপসু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য; পূর্বদিকে আসাম প্রদেশ--- যেখানে আছে মানস জাতীয় উদ্যান৷ দক্ষিণদিকে ৩১ সি নং জাতীয় সড়ক৷ অরণ্যের মধ্যে আছে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি নদী, যেমন--- তির্সা, রায়ডাক, সঙ্কোশ, জয়ন্তী প্রভৃতি৷’

তপন জিজ্ঞাসা করল, ‘এই জাতীয় উদ্যানে কী ধরনের পশু এবং পাখি আছে স্যার?’
---এই জাতীয় উদ্যানে মূলত ব্র্যাঘ্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে৷ তবে এখানে আরও অনেক প্রকার প্রাণী আছে৷ যেমন--- হাতি, গাউর, বুনো শূকর, ভালুক, সম্বর, হরিণ প্রভৃতি৷ এ ছাড়া আছে বহু প্রকার পক্ষী, পাইথন সহ বেশ কিছু প্রজাতির সরীসৃপ ও কয়েক প্রকার উভচর প্রাণী এই উদ্যানের জলাশয়ে বহু প্রজাতির মৎস্য পাওয়া যায়৷

স্বপন বলল, ‘স্যার, এই উদ্যানে কি কি ধরনের উদ্ভিদ পাওয়া যায়?’
--- এখানে উদ্যানের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ পাওয়া যায়৷ আছে শুকনো পর্ণমোচী বন, শাল বন, চিরহরিৎ বন, সাভানা বন এবং শিক্ত বন৷ বিশেষ উদ্ভিদের মধ্যে আছে, শাল চাঁপা, গামার, শিমুল ইত্যাদি৷
এতকিছু শুনে রূপক জিজ্ঞেস করল, ‘‘স্যার আমরা কীভাবে ওখানে যাব এবং কোথায় থাকব?’’
মহিম বললেন, ‘বক্সা জাতীয় উদ্যানে যাবার বহু রাস্তা আছে৷ কলকাতা ও শিয়ালদহ থেকে কিম্বা হাওড়া স্টেশন থেকে যে সকল ট্রেন নিউ আলিপুরদুয়ার যায় কিম্বা ঐ স্টেশন হয়ে অন্যত্র যায় আমরা সেই ট্রেনে যাব৷ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নেমে সেখান থেকে ভাড়া গাড়ি করে আমরা যাব রাজাভাতখাওয়া৷ সেখানে ব্রেকফাস্ট সেরে যাব সান্তালবাড়ি৷ ওখান থেকে সুবিধাজনক জায়গা খুঁজে আমাদের তাঁবু পড়বে৷’

এতক্ষণ মহিম স্যারের কথা শুনে সবুজ বলল, ‘‘স্যার শুনেছি বক্সা অভয়ারণ্যে একটা দুর্গ আছে৷ এ সম্বন্ধে কিছু বলুন৷’’

মহিম বললেন, ‘‘তুমি ঠিকই শুনেছ৷ বক্সা অভয়ারণ্য ঘোষিত হবার অনেক আগেই ওইখানে একটি দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল৷ প্রাচীন দুর্গটি কারা কখন তৈরি করেছিল তা ঠিক জানা নেই৷ তবে এই দুর্গটি খাড়া পাহাড়ের মাথার ওপর অবস্থিত৷ এর চারিপাশে আছে ঘন বনাঞ্চল৷ লোকশ্রুতি অনুসারে প্রাচীন দুর্গটি প্রথমে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ছিল৷ প্রতিবেশী ভুটান এবং কোচবিহারের রাজাদের কেউ এটি তৈরি করেছিলেন৷

একসময়ে ভুটান এবং কোচবিহারের রাজাদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলেও পরে ভুটানের রাজা দেবরাজের সঙ্গে কোচবিহারের ধৈর্যনারায়ণের বিরোধ বাধে৷ ভুটানের সেনাদের হাতে রানা বন্দি হন৷ তখন ইংরেজদের মধ্যস্থতায় কোচবিহারের রাজা মুক্তি পান৷ এরপরেই সিঞ্চুলা চুক্তি অনুসারে ১৮৬৫ সালে ইংরেজ বক্সা দুর্গের অধিকার নিজেদের হাতে নিয়ে এটিকে একটি দুর্ভেদ্য কারাগারে পরিণত করে৷ বলা হয় কুখ্যাত আন্দামানের সেলুলার জেলের পরেই বক্সা দুর্গ ছিল বন্দিদের কাছে বিভীষিকাময়৷ তোমাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি একসময়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে বিপ্ল্বী যেমন, ভূপেন মজুমদার, ত্রৈলোক্য মহারাজ, হেমচন্দ্র ঘোষ, এমনকি নেতাজি সুভাষ বসুকেও এই দুর্গে আটক করে রাখা হয়েছিল৷’’

সবুজ বলল, ‘‘স্যার, বক্সাদুর্গে কী এখনও বন্দিদের রাখা হয়?’’
---না সবুজ, স্বাধীনতা লাভের পরে বক্সা জেলখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ আসলে ১৯৬০ সালে তিব্বত থেকে আসা উদ্বাস্তুদের এই ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল৷ পরে সেই উদ্বাস্তুদের কর্ণাটকে পুনর্বাসিত করে দুর্গটি সেনাদের তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়েছে৷

---স্যার এই দুর্গে কী সাধারণ মানুষ যেতে পারে না?
---আমি তো আগেই বললাম, দুর্গটি বক্সা জাতীয় উদ্যানের মধ্যেই অবস্থিত৷ আগে এই উদ্যানে রাত্রিবাসের অনুমতি দেওয়া হতো৷ ২০১৮ সাল থেকে জঙ্গলের মধ্যে রাত্রিবাস নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ট্রেক করে দূর্গ পর্যন্ত ওঠা যায়৷ এই ট্রেকিং খুবই কষ্টকর এবং বিপজ্জনক, প্রশিক্ষণ না নিয়ে এখানে ট্রেকিং করতে যাওয়া মৃত্যু ডেকে আনার নামান্তর৷ শুধু তাই নয়, এখানে ট্রেকিং এর জন্য দক্ষ গাইড আবশ্যক৷

মহিম স্যারের এই ক্লাসের পরে পনেরো জনের একটি টিম বক্সা উদ্যানের কোলে নেচার ক্যাম্প করার জন্য তৈরি হয়ে যথাসময়ে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে পদাতিক এক্সপ্রেসে যাত্রাশুরু করল৷ মহিম সরকার বাদে বারোজন ছাত্র এবং দুজন সাহায্যকারী৷ এই সাহায্যকারীরা রান্নাবান্না তাঁবু খাটানো থেকে প্রায় সকল কাজেই দক্ষ৷

মহিম সরকারের দলবল একাদশীর রাতে ট্রেনে চেপে পরের দিন নিউআলিপুরদুয়ারে নেমে ভাড়াগাড়ি করে সকাল দশটায় রাজাভাতখাওয়া এসে পৌঁছল৷ ওদের দেখেই বেশকিছু স্থানীয় যুবক বলল, ‘‘আপনাদের কোনো সাহায্য লাগলে বলতে পারেন, আমি গাইডের কাজ করি৷’’

মহিম কিছু বলতে যাবার আগেই সবুজ বলল, ‘‘স্যার এই রেস্তোরাঁর টয়লেট ভালো না, আমার খুব টয়লেট পেয়েছে৷’’
সবুজের কথা শুনে যুবকটি বলল, ‘‘আমার নাম রানা, আমাদের বাড়ি খুব কাছেই৷ তুমি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পার৷’’
মহিম আপত্তি না করে বললেন, ‘‘যাও, কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো৷’’
প্রায় আধঘণ্টা বাদে সবুজ ফিরে এসে মহিম বললেন, ‘‘তুই এত দেরি করলি?’’ আমরা কী তোর ব্রেকফাস্টের জন্য এখানেই বসে থাকব?’’
সবুজ বলল, ‘‘দাজু খুব ভালো মানুষ৷ ওদের বাড়িতেই আমাকে জোর করে ব্রেকফাস্ট করিয়ে দিল৷’’ সবুজের কথায় মহিম স্যারের রাগ কমল না দেখে সবুজ বলল, ‘‘স্যার সত্যি আমি ওদের বাড়িতে কিছু খেতে চাইনি৷’’ দাজু বলল--- আমাদের এই জায়গার নাম ‘রাজাভাতখাওয়া’ কেন তা কি জান? কোচবিহারের বন্দি রাজা ভুটানের রাজার হাত থেকে মুক্তি পাবার পর তার প্রজারা এখানে রাজাকে ভাত খাইয়েছিল; কাজেই আমাদের বাড়িতে কোনো অতিথি এলে আমরা তাদের কিছু না কিছু খেতে দিই; না হলে আমাদের অমঙ্গল হয়৷’’ সবুজের এই কথা শোনার পর মহিম স্যারের মন নরম হয়ে গেল, তিনি জিজ্ঞেস করলেন তোমার ঐ দাজু কোথায়? সবুজ বলল, ‘‘অন্য একটা পার্টির সঙ্গে বেরিয়ে গেছে৷’’

রাজভাতখাওয়া থেকে গাড়ি নিয়ে মহিম সরকার সান্তালবাড়ি এসে কিছু পথ পায়ে হেঁটে বক্সা জাতীয় উদ্যানের পাশে সুবিধাজনক জায়গায় তাঁবু ফেললেন৷ তিনদিন উদ্যানের গভীরে না ঢুকেই পাশের বনাঞ্চলের জৈব বৈচিত্র্যও নদী থেকে জেলেদের ধরা রকমারি মাছের উপর পর্যবেক্ষণের পরে চতুর্থ দিন মহিম সরকার আলিপুরদুয়ার গেলেন উদ্যানের ভিতরে ঢোকার অনুমতিপত্র আনতে৷ যাবার আগে তার দুই সহযোগীদের বলে গেলেন বনের ভিতর যতদূর পর্যন্ত বিনা অনুমতিতে যাওয়া যায় ততদূর ঘুরে দেখতে৷

বনের মধ্যে কিছুদূর যেতেই একটা অচেনা পাখির ডাক শুনে সবুজ তার ক্যামেরা নিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে এগোতে গিয়ে দলছুট হয়ে গেল৷ মহিম সরকারের সহযোগী সুভাষ পোদ্দার ওর পিছনে গিয়েও সবুজকে দেখতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে লেন৷ সবুজ গভীর বনে হারিয়ে গেল৷ এই বনাঞ্চলে মোবাইল সিগন্যাল খুব দুর্বল৷ সবুজের জন্য দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে সুভাষ পোদ্দার বাকিদের নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখলেন মহিম সরকার ফিরে এসেছে৷ সবুজের হারিয়ে যাবার খবর শুনেই তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন৷ এসময়ে বনে ঢোকা নিয়মবিরুদ্ধ ভেবে তিনি স্থানীয় লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ ফিরলেন বেশ কিছুক্ষণ বাদে৷ ক্যাম্পের জন্য সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘‘স্যার সবুজের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল?’’ মহিম বললেন, ‘‘এই অসময়ে কীভাবে সন্ধান পাব৷ যারা এই বন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল তাদের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম৷ সবাই বলল, ‘কাল বনে ঢুকে ওর সন্ধান করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই৷ এখানকার পুলিশে জানানো হয়েছে৷ ওরা বন দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে৷ পুলিশের নির্দেশেই আমি সবুজের বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছি--- সবুজকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ যতদিন ওর কোনো সন্ধান পাব আমি এখানেই থাকব, বাকিদের বাড়ি পাঠিয়ে দেব৷’

সবুজের বন্ধুরা রাতে কেউ ঘুমাতে পারল না৷ সবার মনে একটাই প্রশ্ন এই অচেনা গভীর বনের মধ্যে রাত্রে নানা প্রকার হিংস্র জীবজন্তু ঘুরে বেড়াবে, সেখানে সবুজ কী করে বেঁচে থাকবে?

পরের দিন সকাল দশটায় মহিম সরকার স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে একাই অভয়ারণ্য ঢুকলেন৷ পথে বনকর্মীরা ওদের সঙ্গে যোগ দিল৷ বনের যেখানে গতকাল সবুজ হারিয়ে গেছে সেখান থেকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু হল৷ কিন্তু দুপুর পর্যন্ত সবুজের সন্ধান পাওয়া গেল৷ না৷ এর মধ্যে হঠাৎ কালো মেঘে আকাশ ঢেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সবুজকে খোঁজার কাজবন্ধ রেখে সবাই ফরেস্ট অফিসারের অফিসে এসে আশ্রয় নিল৷ বৃষ্টি থামার পরে রাস্তা দুর্গম হওয়ায় এদিনের মতো অনুসন্ধান বন্ধ রেখে মনে একরাশ দুঃখ ও উদ্বেগ নিয়ে মহিম নেমে গেল ক্যাম্পে৷ বনকর্মীরা বলল, ‘‘আপনি চলে যান আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব, আগামীকাল আপনি এলে আমরা ফোর্টের দিকে অনুসন্ধান করব৷’ পরের দিন সকালেই সবুজের বাড়ি থেকে ওর কাকা এসে উপস্থিত হলেন৷ উনি আসছেন এই খবর ফোনে জানানোয় মহিম সবুজের কাকার জন্য অপেক্ষা করায় অরণ্যে ঢুকতে বিলম্ব হল৷ ওরা যখন বেরোতে যাবে তখনই পুলিশের একটা জিপ এসে ওদের তাঁবুর কাছে দাঁড়াল৷ জিপে পুলিশ ছাড়াও ছিল বনরক্ষী এবং দুজন সামরিক বাহিনীর জওয়ান৷ ওরা নামার পর নেপালি যুবক রানার হাত ধরে জিপ থেকে নামল সবুজ৷ সবুজকে দেখে সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল৷

মহিম সরকার সকলকে বললেন, ‘‘এই মুহূর্তে কেউ সবুজকে বিরক্ত করো না৷ আমি আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে সব শুনে পরে তোমাদের জানাব৷ পুলিশ সহ অন্যরা চলে গেলেও সবুজের কথা মেনে রানা থেকে গেল৷ দুপুরের পরে সবুজ খানিকটা সুস্থ ও স্বাভাবিক হলে সবাই সবুজকে ঘিরে বসল তার অন্তর্ধান রহস্য জানার জন্য৷

মহিমবাবুর প্রশ্নের উত্তরে সবুজ বলল, ‘‘পরশুদিন বনের মধ্যে আমি একটা অচেনা অদ্ভুত পাখির ডাক শোনে তার ছবি তোলার জন্য ওর পিছু নিই৷ পাখিটির টানে আমি ক্রমেই গভীর বনে ঢুকে যাই৷ বনের গোলকধাঁধা কাটিয়ে কিছুতেই আর ফিরে আসার রাস্তা খুঁজে পাই না৷ ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে একটা গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ি৷ যখন ঘুম ভাঙে তখন চারিদিক অন্ধকার৷ তাকিয়ে দেখলাম আমি একটা শিবমন্দিরের বারান্দায় শুয়ে আছি৷ পূজারির কাছে জানলাম ওটা মহাকাল শিব মন্দির৷ পূজারিরা মন্দিরে আসার পথে আমাকে অচৈতন্য অবস্থায় দেখতে পেয়ে এখানে নিয়ে এসেছে৷ সারারাত ওদের ওখানে প্রায় জেগেই কাটালাম৷ মোবাইলে চার্জ নেই, তাই আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি৷ সকালে পূজারিরা একটা রাস্তায় এনে বলে, ‘‘এই পথে অনেকে ট্রেকিং করে দুর্গ পর্যন্ত ওঠে, তুমি এখানে বসে থাক, তাহলে নিচে নামার কাউকে পেয়ে যাবে৷’’

ওখানে গিয়ে আমার মনে হল দুর্গ পর্যন্ত উঠব৷ তাই খুব কষ্ট করে একজনের পিছু পিছু দুর্গ পর্যন্ত উঠলাম৷ ওখানে উঠতেই সেনাকর্মীরা আমাকে ঘিরে ধরে ট্রেকিং এর পারমিট দেখতে চাইল৷ আমার কাছে তা নেই শুনে ওরা আমাকে দুর্গের বাইরে একটি ঘরে বসিয়ে রাখল৷ সৌভাগ্যবশত বিকালে রানা দাজু এসে উপস্থিত হল৷ বৃষ্টির জন্য রানাদাজুর ট্রেকিং পার্টি সঠিক সময়ে আসতে পারেনি৷ যখন এল তখন আর নিচে নেমে যাবার উপায় ছিল না৷ রানা দাজু আমাকে দেখে আমার সব কথা শুনে সেনাদের সঙ্গে কথা বললে সেনারা আমার সুকলের পরিচয়পত্র দেখে দাজুদের সঙ্গে ওখানে রাত্রে থাকার অনুমতি দেয়৷ সেনারাই আমাদের শুকনো খাবার খেতে দেয়৷ রাতে দুর্গের কয়েকটি বন্দিঘরও দেখতে পায়৷

এতকথা শোনার পর মহিম সরকার মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ‘‘ক্যাম্পে আসার আগে আমি তোমাদের নিয়মশৃঙ্খলার বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খ বলেছিলাম৷ সবুজ সেই নিয়মভঙ্গ করেছে৷ পরবর্তী কোনো ক্যাম্পে সবুজকে নিয়ে আসব কী না ভেবে দেখতে হবে৷’’ সবুজকে গালমন্দ করলেও রানার ব্যবহারে মুগ্দ হয়ে মহিম সরকার ও সবুজের কাকাবাবু দুজনেই রানাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন৷ রানা সবুজ সহ অন্যান্যদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাড়ির পথ ধরে৷



Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.