সিমলা-মানালি ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে যেমন সবারই থাকে, তেমনি আমারও ছিল। প্রকৃতি এখানে যেন দুহাত ভরে সাজিয়েছে হিমাচল প্রদেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে। সেই হিমাচলেই আছে রাতে থাকার এক দারুন সাজানো এক রাজকীয় ব্যবস্থা। আমার ইচ্ছা ছিল, সিমলার বদলে যদি পাতিয়ালার মহারাজার রাজমহল চেইল প্যালেস দুটো দিন কাটানো যায়, তবে কিন্তু খারাপ হয় না! এমনিতে এই নিয়ে আমার সিমলাতে দু’দুবার ঘুরতে আসা হয়ে গিয়েছে! সিমলার মত জনপ্রিয় শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, পাইন দেবদারু গাছে মোড়া এক রাজপ্রাসাদে থাকার অভিজ্ঞতা সত্যিই অতুলনীয়।
সিমলাতে আমরা তিনজন, মানে সস্ত্রীক আমি ও আমার একমাত্র মেয়ে, এই ছিল আমাদের ট্যুরের দল। পঞ্জাব ঘুরে চণ্ডিগড় হয়ে আমরা চেইলে পৌঁছেছিলাম। চণ্ডিগড় থেকে তিন ঘন্টা সড়ক পথে যাওয়ার পরে, সিমলার পৌঁছনোর আগেই একটি রাস্তা বেঁকে গিয়েছে চেইল এর দিকে। সিমলা থেকে চেইলের দূরত্ব ৪৪ কিলোমিটার। এই চেইলে রয়েছে পাতিয়ালার মহারাজার রাজমহল “চেইল প্যালেস”। প্রায় ৭৫ একর জমি নিয়ে তৈরি পাতিয়ালার মহারাজার এই সাম্রাজ্য। সে সময়ে ব্রিটিশ দের গ্রীষ্ম কালীন রাজধানী ছিল সিমলা শহর। সুন্দর সাজানো গোছানো সিমলায় ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পুরানো সব বাড়ি। দেখেই বোঝা যায় সেখানে ব্রিটিশ কলোনিয়াল সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট এখনও রয়েছে। সেই সিমলা থেকে কিছুটা উপরে অবস্থিত চেইল নামের এই প্রাকৃতিক সুন্দর জায়গায় পাতিয়ালার মহারাজা ১৮৯১ সালে তাঁর রাজপ্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন। পরে সিমলা শহরে মহারাজা ভুপিন্দর সিংহের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে তৎকালীন পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ শাসক। তখন পাতিয়ালার মহারাজাও নিজের আত্মগরিমা বজায় রেখে সিমলা থেকে আরও উঁচুতে অবস্থিত এই ছোট্ট জায়গা চেইলকে নিজের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়ে রাজপ্রাসাদের আশপাশকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলেন। হিমাচলী পাহাড়ি দেওদর গাছে ঘেরা এই জায়গা থেকে সিমলা সহ আশপাশের সব জায়গাই খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে, হিমাচল প্রদেশের সরকার সরকারি ভাবে এই প্যালেসকে অধিগ্রহণ করেন এবং এখন বর্তমানে এটি হিমাচল প্রদেশ টুরিজম ডিপার্টমেন্টের একটি হেরিটেজ হোটেল হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে!
এই বিশাল জায়গা ‘চেইল প্যালেস’ নামেই পর্যটকদের কাছে অনেক বেশি পরিচিত। সিমলা থেকে দেড় ঘন্টার পথের দূরত্বে অবস্থিত এই প্যালেস দেখতে সকাল দশটা থেকেই ভিড় লেগে থাকে পর্যটকদের। গেটের বাইরে মাথা পিছু একশো ১০০ টাকার টিকিট কিনে দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখতে পারেন এই রাজপ্রাসাদ এবং তার চারপাশের সাজানো নানা সুন্দর জায়গাগুলি।
আমরা একটু অন্যভাবে এই জায়গা উপভোগ করেছিলাম। আমরা সিমলা শহরে থাকার সময় কমিয়ে, সিমলা শহরে না থেকে হিমাচল টুরিজমের এই হেরিটেজ হোটেলে দুটো দিন থেকে দারুন সৌন্দর্য্য উপভোগ করেছিলাম।
এখানে নিজের পছন্দ অনুযায়ী নানা রকম দামের ঘর ভাড়া হিসাবে পাওয়া যায়। প্রধান যে রাজপ্রাসাদ আছে, সেই প্যালেসে মহারাজা, মহারাণীর স্যুট রুম সহ রাজকুমার, রাজকুমারীর রুম, উজির এবং দেওয়ানের রুম নামে সব ঘর রয়েছে। এক এক রুমের এক রাতের খরচ স্বভাবতই একেক রকমের। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে চোদ্দ হাজার টাকার রুমও এই প্যালেসের মেইন বিল্ডিংয়ে রয়েছে। এছাড়া অ্যানেক্স বিল্ডিং এবং জঙ্গলের মধ্যে কটেজেও থাকার ব্যবস্থা করা আছে। তবে আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা অনুযায়ী, আমরা প্যালেসের মেইন বিল্ডিংয়ে থাকার জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। চেইল প্যালেসের নীচের তলায় সাধারণ দর্শকদের ঘুরে দেখার জন্য সকাল থেকেই খোলা থাকে। সেখানেই হোটেলের রিসেপশন কাউন্টার এবং খাবার জায়গা। সেই ডাইনিং হলের পাশে বিলিয়ার্ড খেলার রুম সহ রাজাদের ব্যবহার করা নানা রকমের জিনিস দিয়ে সাজানো মিউজিয়াম করা হয়েছে। সিমলার ঠান্ডাতেও শীতল পানীয় দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ওখানের কর্মীরা আমাদের উপরের দোতলায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে সাধারন দর্শকদের প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ। শুধু মাত্র ওই বিল্ডিংয়ে যাদের বুকিং থাকে, তারাই উপরের এই অপূর্ব সুন্দর ফ্লোরে যেতে পারেন। ঝাড়বাতি লন্ঠন দিয়ে সাজানো টানা বড় বারান্দার কোণে কোণে রাজকীয়তার ছোঁয়া লেগে রয়েছে। বিশাল বড় বড় ঘরের বাইরে রাজকুমার, রাজকুমারী, মহারাজ, মহারাণী লেখা আর দেওয়ালে দারুণ সব হাতে আঁকা ছবির বাহার। দুপুরে খাবার জায়গায় ভিড় নজরে এলো। কাছাকাছি পাঞ্জাব হরিয়ানার মানুষজন ডে আউটিং হিসেবে এই জায়গাকে বেশ পছন্দ করেন, সেটা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। সারাদিন ঘুরে ফিরে বিকেল বা সন্ধ্যায় ফিরে যাচ্ছিলেন অনেকে। সামনের মাঠ জুড়ে রয়েছে নানারকমের ডিজাইন করা বসার জায়গা, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, ছোট্ট ঝর্ণা আর অপূর্ব সুন্দর সব ফুলের বাহার। এখানে ব্যাডমিন্টন এবং লন টেনিসের আলাদা কোর্ট পর্যন্ত রয়েছে। ট্যুরিস্ট কর্পোরেশনের লোকেদের মুখেই জানতে পারলাম, সামনের মাঠে বড় বড় কোম্পানির মিটিং কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যও ভাড়া দেওয়া হয়ে থাকে। তেমনই আমরা ওই প্যালেসে থাকাকালীন একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল, তাই মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল হওয়ার জন্য হয়তো প্যালেসের সামনের সৌন্দর্য্য একটু কম উপভোগ করতে পারলাম। তবে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আর শহরের যানজটের কোলাহল মুক্ত পরিবেশ এই জায়গার আশেপাশের দৃশ্যকে ছবির মত সাজিয়ে রেখেছে।
দুপুরে লাঞ্চ সেরে আমরা পায়ে হেঁটে প্রাসাদের চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলাম। এই প্যালেস থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে একটি মন্দির আছে, সেটিও শান্ত সুন্দর। এছাড়া চিলড্রেন পার্ক, গাড়ি রাখার জায়গা সব সুন্দর ভাবে সাজানো রয়েছে। আর আছে পাইন, রডোডেনড্র্ দেওদর গাছে ঘেরা ছোট ছোট গলির মত সরু পাহাড়ি পথ। আর তার ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের কোণগুলোতে নানা ধরনের কটেজ। পাহাড়ি ডেইজি ফুলে মুড়ে আছে ফাঁকা জায়গা। এত রঙ বাহারি ফুল,নাম না জানা পাখি আর ফুল … এ জায়গাকে করে রেখেছে একদমই আলাদা। প্রকৃতির কোলে নিরিবিলিতে ঘুরে প্রাকৃতিক পাহাড়ি সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করার যথাযোগ্য জায়গাই চেইল। বুঝলাম, কেন রমহারাজা বৃটিশ সরকারের উপর রাগ করে পাহারের কোলে উঁচু এই জায়গাতেই রাজপ্রসাদ বানিয়ে ছিলেন।
চেইলে রাতের পরিবেশ আবার সম্পূর্ণ রকমের আলাদা। এখানে সন্ধ্যা নামে অনেক পরে। সন্ধ্যা সাতটার সময়ে হালকা আলোর ছোঁয়ায় প্যালেসের পরিবেশ যেন আরও মায়াবি হয়ে যায়। দিনভর নানা জায়গা থেকে আসা পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে প্যালেসের সংগ্রহশালা দেখতে। সেই কলকলালির আওয়াজের প্যালেস সন্ধ্যা সাতটার পরে একেবারেই নিঝুম শান্ত হয়ে যায়। কয়েকজন ওখানে রাতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা আমাদের মত পর্যটক ছাড়া অন্য কারও কোন অস্তিত্ব থাকে না। আর মহলের দোতলা তো রাতে আরও নিঃশব্দ, নিজের পায়ের আওয়াজেও নিজেরই চমক লাগার জোগার হয়। অতো বড়ো ফ্লোরে রাতে আমরা কয়েকজন ঘুরে দেখলাম, সামনের মাঠের অন্ধকার উপভোগ করার অভিজ্ঞতাও ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। এখান থেকে পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে সিমলার আসেপাশে ঘুরে দেখে দুপুরে সিমলা ম্যালের কোলাহল মুখরিত পরিবেশ ফিরে এসে নিজেরই বেশ ভালো লাগলো। সিমলা কালিবাড়িতে গিয়ে বাঙালির সংস্কৃতি খুঁজে পেলাম আর সেটা বেশ উপভোগ করলাম। সিমলা ম্যালে পায়ে হেঁটে, বসে, সেখানের হিমাচলী মানুষজনের নিজস্ব ঘরাণাকে চাক্ষুষ করতে বেশ ভালো লেগেছিল। আমরা এবার উঠে বসেছিলাম, সিমলা লাইব্রেরির পাশের উঁচু ঘেরা দেওয়া জায়গাতে। যেই জায়গাতে কয়েক বচর আগে আমির খানের ‘থ্রি ইডিয়েটস’ এর একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল।
তবে সন্ধ্যা নামার পরে আবারও ফিরে এসেছিলাম সেই মায়াবি স্বপ্নপুরী পাতিয়ালার মহারাজার রাজমহল চেইল প্যালেসে। সন্ধ্যায় সেই নিস্তব্ধ ফাঁকা রাস্তা ধরে ফিরতে ফিরতে মনের মধ্যে এক অপূর্ব শান্তি অনুভব হচ্ছিল। প্রকৃতির মাঝে দুটো দিন শান্তিতে নিরিবিলিতে কাটানোর জন্য “চেইল প্যালেস” খুব সুন্দর একটা জায়গা।
এখানে যাবেন বা থাকবেন কি ভাবে --
পাতিয়ালার মহারাজার রাজমহল চেইল প্যালেসে রাত্রিবাস করার জন্য হিমাচল প্রদেশ টুরিজম থেকে রুম বুকিং করতে হবে। আর রাতে এখানে থাকা যদি একান্তই অসুবিধার হয়, তবে তাঁরা চন্ডিগড় থেকে বা সিমলা থেকে যেতে পারেন কেবল দিনের বেলা প্যালেস ঘুরে দেখতে। চণ্ডীগড় থেকে প্রায় ১০৫ কিলোমিটার দূরে, পৌঁছাতে সাড়ে তিন ঘন্টা মত সময় লাগে এবং সিমলা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের এই প্যালেস একবার ঘুরে দেখে আসতেই পারেন।