নববর্ষ সংখ্যা ✍
পৃথিবীর কোথায় প্রথম সূর্যোদয় হয়?
লেখক : তুষার রায়
আমরা সবাই জানি আমাদের এই গ্রহে সূর্য প্রতিদিন পূবে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায়। এই গ্রহে বললাম এই কারণে যে আমাদেরই সৌরমণ্ডলে এমনও গ্রহ আছে যেখানে পশ্চিমে সূর্যোদয় হয় আর পূবে অস্ত যায়।সে গল্প না হয় পরে শোনাব।কিন্তু সূর্য কি প্রতিদিন একই স্থানে অস্ত যায় বা একই স্থানে ওঠে? না-রোজ একটু একটু করে সরে সরে গিয়ে উদয়/অস্ত যায় তাইনা? যেমন গরমের সময় সূর্য ওঠে উত্তর ঘেঁষা পূর্ব দিকে আর অস্ত যায় দক্ষিণ-ঘেঁষা পশ্চিমে।আবার শীত কালে ওঠে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আর অস্ত যায় উত্তর-পশ্চিম কোনে। আমরা আরও জানি সব জায়গায় একসঙ্গে সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় হয়না।সূর্যাস্ত মানে এও নয় যে সূর্য ১২ ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়ে পড়ল।সূর্য সব সময়ই কোথাও-না-কোথাও উদিত হচ্ছে আবার সব সময়ই কোথায়ও অস্ত যাচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন উঠতে পারে-আচ্ছা,এমন কোন যায়গা আছে যেখান থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুই দেখা যার?হ্যাঁ,আছে বৈকি-আমাদের দেশেই আছে-আমাদের দেশের একেবারে দক্ষিণ বিন্দু অর্থাৎ কন্যাকুমারী থেকে সকাল বেলায় সূর্যোদয় আর সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখা যায়।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে আচ্ছা পৃথিবীর কোন স্থানে প্রথম সূর্যোদয় হয়? আমরা জানি জাপানকে বলা হয় ‘উদিত সূর্যের দেশ’ বা “ল্যান্ড অব রাইজিং সান”। জাপানে কিন্তু প্রথমে সূর্যোদয় হয়না-আমাদের সময় থেকে মোটে সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে ওখানে সূর্যোদয় হয়। তাহলে মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে পৃথিবীর কোথায় "প্রথম" সূর্যোদয় হয়?
নিউজিল্যান্ডের গিজবোর্ণ (Gisborne)নামক শহরের উত্তরে ওপোটিকি (Opotiki)’র উপকুলে ‘জাতিয় উদ্যানে’,যাকে ইস্ট-কেপও বলা হয়-এই যায়গা থেকে বছরের প্রায় প্রতি দিন সর্ব-প্রথম সূর্যোদয় দেখা যায়।
এবার দেখা যাক পৃথিবীতে দিন-রাত কিভাবে হয়?
আমাদের পৃথিবী তীব্র গতিতে আপন অক্ষের চারিদিকে ঘুরছে তাই না? আর একবার পুরো ঘুরতে তার লাগে প্রায় চব্বিশ(২৪) ঘণ্টা।এই ঘোরার পথে যে যে স্থান সূর্য-মুখো থাকে সেখানে হয় দিন আর তার উল্টোদিকে হয় রাত।
এবারে দেখা যাক দ্রাঘিমা রেখা বা লঙ্গিচুডিনাল লাইন কি? পৃথিবীর উত্তর আমাদের গোলকের উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত কতকগুলি কাল্পনিক রেখা টেনে রাখা হয়েছে।এই রেখা গুলিকে বলা হয় দ্রাঘিমা রেখা বা Longitude লাইন।এদের মধ্যে প্রাথমিক যে রেখাটি ইংলন্ডের গ্রিণউইচ(Greenwich) নামক স্থানের উপর দিয়ে গেছে তাকে “প্রাইম মেরিডিয়ান” নাম দিয়ে দিন-রাতের হিসাব শুরু করার যে পৃথিবী-ব্যাপী ব্যবস্থা শুরু করা হয় ১৮৫২ খৃস্টাব্দে,সেই হিসাব অনুযায়ী পূর্ব-গোলার্ধের ১২ টি ঘণ্টা আর পশ্চিম গোলার্ধের ১২ ঘণ্টা মিলিয়েই আমাদের গ্রহের সময়ের হিসাব করা হয়।এই হিসাবে আমাদের এই পৃথিবীতে প্রতিদিন শুরু হয় গ্রিণউইচ মধ্যরাত্রি(০০: ০০) থেকে।তাই আন্তর্জাতিক সময় অনুসারে যে কোন স্থানের সময় নির্দেশ করা হয় গ্রিণউইচ সময় + X ঘণ্টা অথবা গ্রিণউইচ সময় - X ঘণ্টা হিসাবে।একে আগে বলা হ’ত জি এম টি বা গ্রিণউইচ মিন টাইম। পরবর্তীতে পৃথিবীর সব দেশ মিলিত হয়ে এর নাম দেওয়া হ’ল ইউ টি সি বা কো-অর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম (UTC-Coordinated Universal Time)। যেমন আমাদের ভারতীয় সময় গ্রিণউইচ সময়ের ৫ ঘণ্টা ৩০ মিনিট আগে।তাই ভারতীয় সময় নির্দেশ করা হয় গ্রিণউইচ সময় +৫:৩০ মিনিট বলে।এই ভাবে গিণউইচ বা প্রাইম মেরিডিয়ান থেকে প্রতি ১৫ ডিগ্রিতে এক ঘণ্টা সময় বাড়তে বা কমতে থাকে-অর্থাৎ গ্রিণউইচ থেকে পশ্চিমে গেলে সময় কমবে আর পূবে গেলে সময় বাড়বে।কারণ টা বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হচ্ছেনা-কারণ পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূবে ঘুরছে,আর ২৪ ঘণ্টায় ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে আসে,অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ১৫ ডিগ্রি হিসাবে ঘুরে চলেছে।
নিউজিল্যান্ডের গিজবোর্ণ (Gisborne)নামক শহরের উত্তরে ওপোটিকি (Opotiki)’র উপকুলে ‘জাতিয় উদ্যান’এর খুব কাছে হল সামোয়া দ্বীপ। সামোয়া ২০১১তে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট-লাইন’কে সুবিধা মত সরিয়ে নিয়ে আসে।এই কল্পিত দ্রাঘিমা রেখাই(আই ডি এল) পৃথিবীর ক্যালেন্ডারের তারিখ ঠিক করে-এই লাইনের পূবে একদিন বেড়ে যায় আর পশ্চিমে এক দিন কমে যায়।বাণিজ্যিক কারণে সামোয়া ২০১১সালের ৩০শে ডিসেম্বর ডেট-লাইনকে সরিয়ে আনে। আগে সামোয়া দ্বীপ পৃথিবীর সবশেষে সূর্যাস্ত দেখত।এখন বছরের কিছু সময় সামোয়া প্রথম সূর্যোদয় দেখে-কিন্তু পুরো বছর নয়। কেন?
কারণ পৃথিবী ত সমতল নয়-গোলাকার; আর এই গোলাকৃতির জন্যই ‘ইস্ট-কেপ’ই এখনও সর্ব-প্রথমে সূর্যোদয় দেখে অবশ্য নিউজিল্যান্ডের হেমন্ত আর শীত ঋতু ছাড়া-ওই সময়ে সামোয়ার এপিয়া(Apia) শহরেই প্রথম সূর্যোদয় দেখা যায়।
কিন্তু মনে রাখতে হবে যে সূর্যোদয় প্রথম সামোয়া বা ইস্ট-কেপ যেখানেই হোক-সেটা কিন্তু পুরাপুরি সত্যি নয়।কেন? আমরা জানি, উত্তর মেরু বা অ্যান্টার্কটিকাতে সূর্য কখনও প্রায় ডোবেনা; ডুবলেও কয়েক মিনিট পরে আবার সূর্যোদয় হয়ে যায়,তাইনা?
তাহলে,সূর্যোদয় কোথায় হয় প্রথমে? বিশাল ধাঁদা ? আসলে সূর্য সব সময়েই কোথাও উদয় হচ্ছে আবার কোথাও অস্ত যাচ্ছে। যত গণ্ডগোল ওই আই ডি এল এর জন্য।