হিমশীতল ঘর৷ সামনে স্টিলের টেবিলে ব্যবচ্ছেদের জন্য মৃতদেহটি রাখা৷ সুইসাইড কেস৷ মুখ বোঝা যাচ্ছেনা৷ বছর পঞ্চাশের বিবাহিত এক মহিলার মৃতদেহ৷ ওপর থেকে তিনটি বড় আলো ফোকাস করা রয়েছে টেবিলে, যাতে ব্যবচ্ছেদের সময় দেখতে অসুবিধা না হয়৷ সুনিবেশ ডাক্তারি সরঞ্জাম নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে, ডাক্তারি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, ডা. চন্দ্রশেখরের কাছে ট্রেনিং এ এসেছে৷ ডা. চন্দ্রশেখর মর্গ রুমে ঢুকে একবার মৃতদেহটি দেখে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান৷ পনেরো বছরে এই প্রথম কোনো মৃতদেহ দেখে শরীরে পাক দিয়ে উঠলো ওর৷ শরীরটা থর থর করে কাঁপছে৷ বার বার মুখে চোখে জল দিয়েও নিজেকে সামলাতে পারেননা চন্দ্রশেখর৷ চন্দ্রশেখরের ছাত্র সুনিবেশ পোস্টমর্টম রুমে স্যারের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ স্যার আসছেনা দেখে তাড়াতাড়ি ভেতরে যান দেখে চন্দ্রশেখর নিজের রুমে গা এলিয়ে বসে আছেন৷
‘স্যার আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
চন্দ্রশেখর বলেন, ‘হ্যাঁ কেসটা মি. চৌবেকে দিয়ে করিয়ে নাও৷ আমি আজ বাড়ি চলে যাচ্ছি৷ শরীর ঠিক নেই৷’
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে কোনো মতে নিজের গাড়িতে উঠে বসেন চন্দ্রশেখর৷ ব্যবচ্ছেদের জন্য স্ট্রেচারে রাখা মৃতদেহের গলার কাছে থাকা জরুলটা বার বার চোখের সামনে উঠে আসছে আর তখনি বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠছে৷ আজ অবধি প্রায় সাড়ে পাঁচশো মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করেছে চন্দ্রশেখর সেন৷ কিন্তু কখনো এরকম হয়নি৷ এইরকম গলার কাছে জরুল চন্দ্রশেখরের খুব কাছের একজনের ছিল৷ তবে কি এটা তার মৃতদেহ! সেই শরীরের প্রতিটি খাঁজ, প্রতিটি তিল ওর হাতে গোনা, চেনা৷ যে শরীরটাকে একসময় ভালোবাসা, সোহাগে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিল সেই শরীরটাকে কেটে ছিড়ে ছিন্ন বিছিন্ন করে দিতে হবে এতটা প্রফেশানাল হতে পারেননি চন্দ্রশেখর৷
গাড়িটা এসে দাঁড়ায় বাঘাযতীনের একটি কমপ্লেক্সের সামনে৷ চন্দ্রশেখর গাড়ি থেকে বেরিয়ে লিফটে উঠে সোজা পনেরো তলায় নিজের ফ্ল্যাটে চলে যান৷ বেল দিতে লতা দরজা খোলে৷ টলমল শরীরে চন্দ্রশেখর ঘরে ঢোকেন বলেন, ‘আমার ঘরে একটু জল পাঠিয়ে দাও না লতা’৷ ‘তোমার কি হয়েছে? শরীর ঠিক আছে তো! পাশের ঘরের বিছানা থেকে মাথা তুলে বলে ওঠেন সুদর্শনা! চন্দ্রশেখরের স্ত্রী আজ প্রায় দশবছর বিছানায় শয্যাশায়ী৷ চন্দ্রশেখর, পর্দা সরিয়ে স্ত্রীর ঘরে উঁকি দিয়ে বলেন, ‘না গো তেমন কিছু নয়, খুব ক্লান্ত লাগছে৷ ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে৷’ ডাইনিং পেরিয়ে চন্দ্রশেখরের ঘর, ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দেন৷ হসপিটাল থেকেই হালকা বুকটা চিন চিন করছিল৷ ড্রয়ার থেকে একটা সরবিটেড এর বড়ি নিয়ে জিভের তলায় রাখেন৷ এসিটা বাড়িয়ে সোফায় শুয়ে পড়েন৷ লতা জল এনে টেবিলের ওপর রাখে৷ চন্দ্রশেখর একবার চোখ মেলে বলেন, ‘রেখে দাও আমি খেয়ে নেব৷’ চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে ওই মৃতদেহটির চেহারা৷ ভয়ে নামটা দেখেননি৷ কিন্তু এরকম জরুল তো দেবপ্রিয়ারই ছিল৷ ওই জরুলটা চন্দ্রশেখরের ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে৷
দুই
মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস সবে শেষ হয়েছে৷ দেবপ্রিয়া লাইব্রেরিতে নোট নিচ্ছিল৷ চন্দ্রশেখর পাশে এসে বসে বলে, ‘দেবী কাল চলো কোথাও ঘুরে আসি৷’ খাতা থেকে মুখ না তুলেই দেবপ্রিয়া বলে, ‘কোথায় যাবে?’ ‘আরে চলো না তোমাকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাব৷’ গাড়ি চালিয়ে চন্দ্রশেখর সেদিন দেবীকে নিয়ে গিয়েছিল বর্ধমানের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে৷ গ্রামের নাম বারমল্লিক৷ গ্রামের শেষ প্রান্তে প্রাচীন রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে৷ চন্দ্রশেখর ওর বন্ধুদের মুখে শুনেছিল ওই মন্দিরের কথা৷ গাড়ি থামিয়ে হেঁটে কুড়ি মিনিট মতো গেলে একটা জংগলের মধ্যে প্রাচীন সেই মন্দির৷ কী জানি কি হয় সেদিন৷ চন্দ্রশেখর আর দেবপ্রিয়া ওই মন্দিরে গিয়ে অনেক সময় বসে থাকে৷ নিরিবিলি জায়গা৷ বৈশাখের বিকেলে মৃদুমন্দ বাতাসের মধ্যে চন্দ্রশেখর ও দেবপ্রিয়া রাধাকৃষকে সাক্ষী রেখে পরস্পরকে নিজের করে নেয়৷ স্থির করে ডাক্তারি পড়া শেষ হলে দুজনে প্রথমে বিয়ে করবে তারপর গ্রামে গিয়ে ডাক্তারি করবে৷ কিন্তু থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হবার মাসখানেকের মধ্যে হঠাৎই একদিন দেবপ্রিয়া কাঁদতে চন্দ্রশেখরের সংগে দেখা করে৷ প্রথমে চন্দ্রশেখর একটু ঘাবড়ে যায়৷ দেবপ্রিয়া বলে,‘চন্দ্র, আমি আর ডাক্তারি পড়া কনটিনিউ করতে পারব না৷’ চন্দ্রনাথ অবাক হয়ে যায় বলে, ‘কী বলছো যাতা, তোমার ফার্স সেকেন্ড ইয়ারে এত ভালো রেজাল্ট, তবু কেন তুমি এসব ভাবছো?’ দেবপ্রিয়া চন্দ্রশেখরের হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘না চন্দ্র, আমি পারব না৷ প্র্যাকটিকাল ক্লাসে আজ ব্লাড স্যাম্পেল নেবার সময় আমার শরীর গুলিয়ে উঠেছে৷ ভেতর থেকে একটা অস্বস্তি, প্রথম পাঁচ দিন আমি জোর করেই একরকম পরীক্ষাগুলো করছিলাম৷ কিন্তু এতো সবে শুরু এরপর তো অনেক কিছু আছে৷’ চন্দ্রশেখর দেবপ্রিয়ার চোখের জলটা রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দেয় বলে, ‘দূর বোকা মেয়ে ডাক্তারি পড়তে এসে অত ভয় পেলে চলে! কত লোকের কত রকম সমস্যা থাকবে সেগুলো ভালো করে দেখে তবে তো চিকিৎসা করতে হবে! তুমি যদি সামান্য রক্ত দেখে এত ভয় পেয়ে যাও তবে ডাক্তারি করবে কীভাবে! বাড়ি যাও মাথা ঠান্ডা করে ভাবো!’ ‘চন্দ্রশেখর নানা ভাবে বোঝালেও, দেবপ্রিয়া কিছুতেই রাজি হয়না৷ দিনের পর দিন ক্লাস কামাই করতে থাকে মেয়েটি৷ শেষে একদিন চন্দ্রশেখর দেবপ্রিয়াদের বাড়ি পৌছে যায়৷ কিন্তু কোনো লাভ হয় না৷ দেবপ্রিয়া ক্লাসগুলোয় অনুপস্থিতই থাকে৷ চন্দ্রশেখর প্রথম প্রথম দেবপ্রিয়াদের বাড়িতে গিয়ে নোট দিয়ে আসতো৷ কিন্তু পড়ার চাপে পরের দিকে সেটা আর সম্ভব হত না৷ দেবপ্রিয়াও ক্রমশ যোগাযোগ কমিয়ে দিচ্ছিল৷ মেডিকেল কলেজে একসংগে পড়ার সময় যেভাবে দুজনের দেখা হত তাও ধীরে ক্ষীণ হতে থাকে৷ চন্দ্রশেখর মেডিকেল কলেজে পড়া শেষ করে স্পেশালাইজেশনের জন্য বাইরে গেলে দেবপ্রিয়ার সংগে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ আজ এত বছর পর দেবপ্রিয়া নামটা যে আবার ফিরে আসবে চন্দ্রশেখরের জীবনে তা ও নিজেও ভাবতে পারেনি৷ কিন্তু কী কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিল দেবপ্রিয়া! চন্দ্রশেখর বন্ধুদের মুখে সে সময় শুনেছিল দেবপ্রিয়ার বাবা দেবপ্রিয়াকে ভালো একজন উকিলের সংগে বিয়ে দিয়েছিলেন৷ হঠাৎ কী এমন হল দেবপ্রিয়ার জীবনে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা একবার দেখতেই হবে চন্দ্রশেখরকে৷
তিন
পরদিন ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে প্রথমেই সুনিবেশকে নিজের রুমে ডাকেন চন্দ্রশেখর৷ ঘরে ঢুকতেই সুনিবেশ বলে, ‘স্যার আপনার শরীর এখন কেমন আছে?’ চন্দ্রশেখর হেসে বলেন, ‘ভালো, ভালোই আছে৷ কালকে শেষ মোমেন্টে ডা. চৌবেই কেসটা করলেন তো?’ সুনিবেশ বলে, ‘আর বলবেন না, প্রথমে তো ভেবেছিলাম করবেনই না৷ তবে দেখলাম আপনাকে খুব রেসপ্রক্ট করেন৷’
‘কী বলছে রিপোর্টে?’ চন্দ্রশেখর বলে ওঠেন৷
‘সুইসাইড কেস, মৃত্যুর জন্য চরম চেষ্টা করেছে ভদ্রমহিলা প্রথমে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে তারপর ট্রেন লাইনে গলা দিয়েছে৷ মুখটা তো কিছু বোঝাই যাচ্ছেনা৷ তবে মারা যাবার আগে নিশ্চিত এক চোট অশান্তি হয়েছিল তাছাড়া নিয়মিত মেয়েটিকে মার ধোর করত, সারা শরীরে ক্ষত চিহ্ণ৷’ ‘একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের সমাজে মহিলাদের মার খাওয়ার শেষ হল না৷’ কথাটা বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন চন্দ্রশেখর৷ ডিপার্টমেন্টের কয়েকটা কাজ সেরে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়েন তারপর সোজা চলে যান দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে৷ ওই হাসপাতালের জেনারেল ফিজিশিয়ান ডা. অনিরুদ্ধ বোস চন্দ্রশেখরের ব্যাচ মেট৷ এখনও অবধি এই অনিরুদ্ধই সেই সময়কার সব বন্ধুদের সংগে যোগাযোগ রেখে চলেছে৷ চারজন পেশেন্ট দেখার পর পাঁচ নম্বর নাম ডাকতে অনিরুদ্ধর ঘরে ঢোকেন চন্দ্রশেখর৷ অনিরুদ্ধ বলেন, ‘এই চন্দ্র কী ব্যাপার? তোর আবার কী হল?’ চন্দ্রশেখর হেসে বলেন, ‘আরে না তেমন কিছু না৷ আমি এসেছি তোর কাছে সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে৷ তোর দেবপ্রিয়ার কথা মনে আছে?’ অনিরুদ্ধর ঠোটের কোণায় মিষ্টি হাসি দেখা দেয় বলেন, ‘কে তোর দেবী?’ ‘আরে ইয়ার্কি ছাড় মনে আছে তোর দেবীকে?’ চন্দ্রশেখর বলে ওঠেন৷ অনিরুদ্ধ বলেন, ‘আরে কেন মনে থাকবেনা, থার্ড ইয়ারে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিল৷ তারপর তোর সংগে সম্পর্কটাও কনটিনিউ হল না৷’ ‘হ্যাঁ আমারই ভুল, ওর সংগে যোগাযোগ রাখাটা আমারই উচিৎ ছিল৷’ চন্দ্রশেখর বলে ওঠেন৷ অনিরুদ্ধ চোখের চশমাটা নাকের ওপর তুলে বলেন, ‘হল কী? আবার পুরানো প্রেম জেগে উঠল নাকি!’ চন্দ্রশেখর একটু চুপ করে থেকে বলেন, ‘নারে আমি বোধহয় ওর জীবনটা নষ্ট করে ফেললাম৷’ অনিরুদ্ধ হেসে বলেন, ‘আরে দোস্ত নিজেকে দোষ দিস না৷ দেবী তো ভালোই আছে, বহাল তবিয়তে৷ ওর বর এখন সুপ্রিম কোর্টে প্রাক্টিস করেন৷ কথা বলবি ওর সংগে এই রিসেন্ট ফেসবুকে যোগাযোগ হয়েছে ওর সাথে৷’ চন্দ্রশেখরকে কিছু বলতে না দিয়ে অনিরুদ্ধ নিজেই মোবাইলটা বের করে নম্বর ডায়াল করে ফোনটা চন্দ্রশেখরের হাতে ধরিয়ে দেন৷ ওপাশ থেকে একজন মহিলা বলেন, ‘বল অনি, কেমন আছিস? সব খবর টবর কি?’ চন্দ্রশেখর একটু থতমত খেয়ে বলেন, ‘আপনি মানে, তুমি তুমি কি দেবপ্রিয়া?’‘কে?কে বলছেন?’ ওপাশ থেকে ভদ্রমহিলাটি বলে ওঠেন৷ ‘আমি ডা.চন্দ্রশেখর, মেডিক্যাল কলেজের ১৯৯৪ এর ব্যাচ৷’ ‘কে চন্দ্র?মানে?কেমন আছো? তুমি তো আমাকে ভুলেই গেলে৷ যাইহোক তোমাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে একদিন এসো না আমাদের গড়িয়ার বাড়িতে৷’ চন্দ্রশেখরের বুকের ভেতরে তখন আনন্দের ঝরণা বয়ে যাচ্ছে৷ কথা বলতে বলতে দেবপ্রিয়ার হাসিমুখটা মনের মধ্যে ভেসে ভেসে উঠছে৷ এখন খেয়াল হয় পোস্টমর্টেম এর সময় মহিলার নামটিও দেখেননি চন্দ্রশেখর, শুধু গলার ওই জরুলটাই ভ্রান্ত করে দিয়েছে ডা চন্দ্রশেখরকে৷