ভ্রমণ

ভ্রমণ

কেদারনাথের ডাকে

লেখক : অন্তরা বিশ্বাস

কেদারনাথের ডাকে

ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার হিন্দুদের একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র৷ মন্দাকিনী নদীর তীরে অবস্থিত শহরটিকে ঘিরে থাকে হিমালয়ের তুষারাবৃত শৃঙ্গ৷ কেদারনাথ শহরে অবস্থিত কেদারনাথ মন্দির হিন্দুদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান৷ এই মন্দিরটি ছোট চার ধাম তীর্থ-চতুষ্টয়ের অন্যতম৷ তাই এই ধামে যাওয়ার ইচ্ছেটা আমার বহুদিনের ছিল৷ গত বছর তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম৷ সে এক যাত্রা৷ অন্তত যাত্রা৷ শিবের কাছে নিজের মনের শান্তির কারণে৷ প্রাণের আনন্দের কারণে৷ এই যাত্রা পথে মহাবিশ্বের আধার স্বয়ং শম্ভু আমাকে পথ দেখিয়েছেন৷ আমি আমার পাঁচ জন সহকর্মী সঙ্গে বেরোনোর পূর্বে ঘেঁটে নিয়েছিলাম ইতিহাসের পাতা থেকে কেদারনাথের ছোট করে একটি মাহাত্ম্য৷ এই যাত্রা হতে পারে প্রাণঘাতী৷ কিন্তু সাবধানতা আর ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস পৌঁছে দিয়ে ছিল সর্র্বেচ্চ শান্তির স্থানে৷ ভগবানের কোলে৷

পঞ্চকেদার সম্পর্কে একটি কিংবদন্তি পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ পাণ্ডবরা কৌরবদের পরাজিত করার পর যুদ্ধের সময় তাদের গোত্রহাত্য এবং ব্রাহ্মণাহত্যা করার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে৷ তারা তাদের রাজ্য আত্মীয়দের হাতে তুলে দিয়ে ভগবান শিবের খোঁজ করতে গেল৷ প্রথমে শিবের প্রিয় শহর হিসেবে পরিচিত পবিত্র নগরী কাশীতে যান তারা৷ যাইহোক, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মৃত্যু এবং অসততার জন্য শিব গভীরভাবে বিরক্ত ছিলেন তাই পাণ্ডবদের প্রার্থনার প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ তিনি নন্দীর রূপধারণ করেন এবং গাড়ওয়াল অঞ্চলে লুকিয়ে থাকেন৷ কাশীতে শিবকে না পেয়ে পাণ্ডবরা গাড়ওয়াল হিমালয়ে চলে যান৷ ভীম গুপ্তকাশীর কাছে একটি ষাঁড়কে চরাতে দেখেন৷ তিনি ষাঁড়টিকে এর লেজ এবং পিছনের পা দিয়ে ধরেছিলেন৷ ষাঁড়ের আকারে তৈরি শিব ভূমিতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন এবং পরে কিছু অংশে আবার আবির্ভূত হন, কেদারনাথে কুঁজ গোলাপের সঙ্গে, বাহুগুলি তুঙ্গনাথে, মুখ রুদ্রনাথে, নাভি (নাভি) এবং পেট মধ্যমহেশ্বর এবং লোমগুলি কল্পেশ্বরে উপস্থিত হয়েছিল৷ পাণ্ডবরা এই স্থানে পাঁচটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন৷

এই বার আসা যাক ভ্রমণ পথের বর্ণনায়৷

এই মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে মানুষের পদচারণা বহুযুগ ধরে৷ এই ট্রেক রুটে গাড়োয়াল হিমালয়ের সবরকম প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ধরা পড়ে৷

হরিদ্বারই হচ্ছে চারধামের সূচক৷

আমরা রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি হয়ে বিকেলে হরিদ্বারের পৌঁছাই৷ সবাই হরিদ্বার পৌঁছে সেখানে একটি রাত ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘে কাটিয়ে পরেরদিন সকালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা দেওয়া হয়৷ কারণ, শোনপ্রয়াগ বা তার ২ কিলোমিটার আগে সীতাপুর পৌঁছতে গাড়িতে প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় লাগে৷ ঋষিকেশ, দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ হয়ে সীতাপুর যেতে বিকেল হয়ে যায়৷ শোনপ্রয়াগে হোটেল থাকলেও, বেশিরভাগ পর্যটকই থাকেন সীতাপুরে৷ এখান থেকে গৌরীকুণ্ড ৭ কিলোমিটার৷ তাই আমরা গৌরী কুণ্ডেই আগে পৌঁছে যাই৷ শোনপ্রয়াগ থেকে গৌরীকুণ্ড যেতে হয় স্থানীয় জিপে৷ বাইরের গাড়ি এই পথে যেতে দেওয়া হয় না৷ আমরা স্থানীয় জিপে গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে যাই প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ৷ তীব্র ঠান্ডা৷ বাইরে অঝোরে বৃষ্টি৷ প্রকৃতি আমাদের বৃষ্টি ধারাতেই স্বাগত জানায়৷ আমরা একটি স্থানীয় হোটেলে উঠি৷ সেখানে খাওয়া দাওয়ার পর সন্ধ্যার মধ্যেই শুয়ে পড়ি৷ কারণ পরের দিন আসল যাত্রাশুরু৷

কেদারের পথে আসল যাত্রাশুরু হয় গৌরীকুণ্ড থেকেই৷ এখান থেকে চড়াই পথ শুরু হয়৷ কেউ হেঁটে, কেউ ঘোড়ায় আবার কেউ দোলায় কেদারনাথের পথে অগ্রসর হন৷ শুরুতেই ঘোড়া নিলে একেকজনের ২,৩০০ টাকার মতো ভাড়া লাগে৷ টাকার কমবেশি হতে পারে৷ আমরা সকলে ঘোড়া নেই৷ তবে কেন জানি না বৃষ্টি আমাদের পিছু ছাড়েনি৷ যদিও সব সময় বৃষ্টি হয় না৷ কোনো তীর্থ যাত্রী মাঝপথে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে কোনো জায়গা থেকে ঘোড়া নিলে তখন রীতিমতো দরদাম করতে হয়৷ দোলায় মূলত বয়স্ক বা শিশুদেরই তোলা হয়৷ এক্ষেত্রেও দরদাম করতে হয়৷ অনেক বাচ্চাকে আবার ঝুড়িতে বসিয়েও নিয়ে যান স্থানীয় মালবাহকরা৷

২০১৩ সালের ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে পর্যন্ত গৌরীকুণ্ড থেকে কেদারনাথের দূরত্ব ছিল ১৪ কিলোমিটারের মতো৷ কিন্তু সেই রাস্তা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার নতুন করে যে পথ তৈরি করা হয়েছে, তাতে দূরত্ব বেড়ে হয়েছে প্রায় ২২ কিলোমিটার৷ রাস্তার বেশিরভাগ অংশই চড়াই৷ ফলে যাত্রা একেবারেই সহজসাধ্য নয়, বরং বেশ কঠিন৷ দীর্ঘ যাত্রাপথে বেশিরভাগ মানুষই ক্লান্ত হয়ে পড়েন৷ খাওয়ার জন্যও একাধিকবার থামতে হয়৷ তাই বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে৷ এই কারণে ভোরবেলা যাত্রাশুরু করি আমরা৷ তাহলে সন্ধে নামার আগেই কেদারে পৌঁছে যাওয়া যায়৷ হেঁটে উঠলে সঙ্গে ওয়াকিং স্টিক রাখতে হবে৷ যাঁরা নিয়মিত পর্বতারোহণ করেন, তাঁদের কাছে ওয়াকিং স্টিক থাকে৷ না হলে গৌরীকুণ্ড থেকে লোহা লাগানো বাঁশের লাঠি কিনতে হয়৷ দাম ২০-২৫ টাকার মতো, ফেরার সময় ফেরত দিলে আবার ১০ টাকা পাওয়া যায়৷ যথাসম্ভব হাল্কা ব্যাগ নিয়ে কেদারের পথে যাত্রা করা উচিত৷ না হলে ভারী ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে আরও বেশি কষ্ট হয়৷ মোটা সোয়েটারের বদলে হাল্কা জ্যাকেট বা পুলওভার পরে নেওয়াই ভালো, যাতে সহজে খুলে ফেলা যায়৷ কারণ, ভোরবেলা ঠান্ডা লাগলেও, যত বেলা বাড়ে এবং হাঁটা চলতে থাকে, ততই গরম লাগে৷ যখন-তখন বৃষ্টি হতে পারে, তাই সঙ্গে রেনকোট রাখতেই হবে৷ আমরা সকলেই রেনকোট পরেছি৷ যাঁদের শ্বাসকষ্টের বা হার্টের সমস্যা আছে, তাঁদের সঙ্গে ইনহেলার বা প্রয়োজনে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা উচিত৷ না হলে সমস্যা হতে পারে৷

বেশিরভাগ যাত্রীই একদিনে হেঁটে কেদারনাথ পৌঁছে যান৷ তবে এখন মাঝপথে কিছু তাঁবু হয়েছে৷ বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লে সেখানে রাত কাটানো যায়৷ আমরা অবশ্য কষ্ট করে হলেও পৌঁছে যাই কেদারের মূল মন্দিরে৷ প্রকৃতি এখানে অপরূপ৷ কোথাও ঝর্নার ধারা বিধ্বংসী তো কোথাও খরস্রোতা নদীর মতো৷ পাহাড়ের পথ এঁকে বেঁকে চলছে উপরে ঈশ্বরের কাছে৷
কেদারে অন্তত থাকা উচিত৷ চোখের সামনে মেঘের ফাঁক দিয়ে থেকে থেকে তীর্থযাত্রীরা যাতায়াত করছেন৷ যদিও আমরা ঘোড়ায় করেই যাই৷

মন্দিরের পিছনেই হিমালয় পর্বতের শৃঙ্গ৷ ভোরবেলা সূর্যোদয় এবং বিকেলে সূর্যাস্ত দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়৷ আমরা পরের দিন ভোর বেলা হিমালয়ের শ্বেতশুভ্র বরফের মাঝখান থেকে রবির আভা দেখতে পেয়ে মুগ্দ৷

কেদারনাথে খুব একটা আরামদায়ক হোটেল নেই, খাওয়া-দাওয়াও সাধারণ৷ তবে তীর্থে গিয়ে এটুকু মেনে নেওয়াই যায়৷ বিশেষ করে সেই তীর্থস্থানের নাম যদি হয় কেদারনাথ৷ আমরা কেদারনাথের মন্দিরের পুরোহিতের তৈরি লজে উঠি৷ সৌভাগ্যবশত মন্দির সেটা চত্বর সংলগ্ণই ছিল৷

হেঁটে ওঠার পথে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূর থেকে মন্দির দেখতে পাওয়া যায়৷ তখন যেন এক নিমেষে যাবতীয় ক্লান্তি দূর হয়ে যায়৷ নিজে থেকেই পা দুটি মন্দিরের দিকে এগোতে থাকে৷ সন্ধেবেলা আরতি দর্শন করলে মন ভালো হয়ে যায়৷ পরদিন ভোরবেলা তিনটে-সাড়ে তিনটেয় উঠে মন্দিরে চলে যেতে পারলে আসল বিগ্রহ স্পর্শ করার সুযোগ পাওয়া যায়৷ একটু বেলা হয়ে গেলেই কিন্তু বিগ্রহ শুধু দর্শন করা যায়, স্পর্শ করা যায় না৷ কেদারনাথে সবাই সমান, সবাইকেই লাইন দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়৷ কেউ লাইন ভেঙে আগে চলে যেতে পারেন না৷ এটা আমার কাছে অভূতপূর্ব লেগেছে৷ তীর্থযাত্রীদের একটা বড় অংশ বাঙালি, তাই পুরোহিত থেকে শুরু করে লজের মালিক, কর্মী, দোকানদাররা বাংলা অল্পবিস্তর বুঝতে পারেন৷ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা তীর্থযাত্রীদের এসে পুরোহিতরা প্রশ্ণ করেন, বাঙালি? ইতিবাচক উত্তর দিলে তাঁরা স্পষ্টতই খুশি হন৷ মাথায়-পোশাকে পবিত্র জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে দেন৷

বেলা পড়তে আমরা ভীম শিলা দর্শন করি৷ এই ভীম শিলাই মন্দিরটিকে ২০১৩ সালের দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে৷
ধীরে ধীরে আবার কলকাতায় পথচলা শুরু করি আমরা৷ ঈশ্বর প্রকৃতির মাঝে এত অপূর্ব ভাবে বসে আছেন৷ তা নিজের চোখে না দেখলে এই সুন্দর ভূভারতে জন্মের সার্থকতা কোথায়!



Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.