গল্প

গল্প বাথরুমের ভিতর

বাথরুমের ভিতর

লেখক : বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথম দু’দিন কিছু টের পায়নি অতীন৷ তৃতীয়দিন দুপুরে ওর প্রথম একটা কিছু মনে হয় আর চতুর্থ দিন সেই মনে হওয়াটা একটা অবয়ব পায়৷ পঞ্চম দিন থেকে ও স্নান করতে বাথরুমে ঢুকলেই একটা ঘোর ওকে গ্রাস করতে থাকে৷

অতীন এখন যে চাকরিটা করে সেখানে, চড়চড় করে না হোক, উন্নতির সম্ভাবনা আছে৷ গালভরা একটা নামও আছে ব্যাপারটার, ‘করপোরেট ট্র্যাভেল’৷ দেশবিদেশের বড়-মেজ এমনকি ছোট কোম্পানিরাও এখন আগামীর রূপরেখা ঠিক করার জন্য নিজেদের এক্সিকিউটিভদের দু-তিনদিনের জন্য হোটেলে নিয়ে গিয়ে রাখে৷ কোম্পানির ক্ষমতা অনুসারে সেই হোটেল তিনতারা থেকে পাঁচতারা হয়৷ সেখানে দু-আড়াইদিনের মাথা-মারামারির পর লোকগুলো একবেলার ছুটি পায় ঘোরাঘুরি আর কেনাকাটির জন্য৷ এবার এই হোটেল এবং ঘোরাঘুরির ব্যবস্থা অতীনের কোম্পানি করে৷

না, অতীন সেই কাজটার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয়৷ ও কলকাতার অফিসে বসে কোম্পানির অ্যাকাউন্টস সামলানোর কাজ করে, আরও কয়েকজনের সঙ্গে৷ কাজের ফাঁকে-ফাঁকেই শুনতে পায় যে ওদের কোম্পানি গত সপ্তাহে চিল্কায় দেড়শো ডাক্তারের কনফারেন্স করেছে৷ আগামী সপ্তাহে, চার্টার্ড অ্যাকাউণ্ট্যান্টদের কনফারেন্স আছে কালিম্পঙে৷ প্রথমটার বিল কোনও ওষুধের কোম্পানি দেবে, দ্বিতীয়টার বিল কোনও বড় বানিজ্যিক সংস্থা৷ হিসেবগুলো মিলিয়ে দেখা অতীনের কাজ, হিসেবের ভিতরে, কোম্পানির স্বার্থে, কিছু জল মেশানো অতীনের দায়িত্ব৷ আর সেই জল মেশানোর সময় নিজের ছোট্ট কিউবিকলে বসে চিল্কার হ্রদ কিংবা কালিম্পং’এর বরফের কথা ভাবাটা অতীনের শখ৷

কম্পিউটারের সামনে বসে অতীনের কানে আসত, কীভাবে স্থানীয় দোকানিদের থেকে অল্প কমিশন খেয়ে একটু বেশি দামে জিনিস গছানো গেছে ক্লায়েন্টদের৷ কিংবা, আইনত মদ পাওয়া যায় না এমন কোনও জায়গায় , চার বোতল যোগাড় করে দেবার ফাঁকে নিজের জন্যেও এক বোতল রেখে দিতে পেরেছে কেউ৷ অতীন মনে মনে ওই অ্যাডভেঞ্চারটার অংশ হয়ে যেত বলেই, ওর চোখে দু’নম্বরীটা ছিল ছোট্ট একটা অসুখ যাকে জীবন থাকলে পরে বহন করতেই হবে৷

সব অসুখই ছোট ছিল৷ যতদিন না বড় অসুখটা এল৷

একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস ছিল অতীনের৷ ভাড়াবাড়িতে বাবা-কাকা একান্নবর্তী, সারাদিন কাঁইমাই, রাতের দিকে বারান্দার এককোণ ঘিরে ওর পড়ার জায়গাটায় বসে অঙ্কের সংখ্যাগুলোর ভিতর স্বপ্ণ দেখতে পেত অতীন৷ সেই স্বপ্ণ কখনও চাকরি কখনও বা অন্তরার রূপ ধরে দেখা দিত৷ অনেক রাত অবধি জেগে অতীন ওর স্বপ্ণগুলোর সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে উঠবার চেষ্টা করত, যতক্ষণ না ঘুম এসে জড়িয়ে ধরছে চোখদুটোকে৷

চাকরি পাওয়ার পর সেই রাত জাগার অভ্যাস বদলাতেই হয়েছিল৷ সে আবার একবার ফিরে এসেছিল, বুতান পৃথিবীতে আসার পর৷ সেই সময় মাঝেমাঝে মিতালি ঘুমিয়ে পড়লে, বাচ্চার কাঁথা পাল্টানোর জন্য জেগে থাকতে হত অতীনকে৷ তখন একটা হোটেলের অ্যাকাউন্টস দেখত অতীন যার ঝাঁপ বেলা বারোটায় খুললেও, অফিস খুলে যেত সকাল সাড়ে ন’টাতেই৷ তবু কষ্ট হত না অতীনের৷ বরং ও ফিরে যেতে পারত সেই প্রাক-যৌবনের দিনগুলোয় যখন ঋতুদি ছাদে উঠলেই, নিচে দাঁড়িয়ে থাকত তপেনদা৷ ঋতুদির মেলে দেওয়া ওই ভিজে কাপড় থেকে গড়িয়ে পড়া জলের টাপটুপ, অতীনের মাথার মধ্যে একটা ঘোড়ার পায়ের ধ্বনি জাগিয়ে তুলত, যে ঘোড়াটার পিঠে ও নিজে পৃথ্বীরাজ আর অন্তরাই সংযুক্তা৷

অন্তরা আমেরিকা চলে গেল বিয়ের পরপরই৷ ওদের পাড়া, যা তখনও কলকাতা হয়নি, খুব গর্বিত হয়েছিল ঘটনাটায়৷ প্রায় ষাটজন লোক অন্তরাকে সি-অফ করতে দমদমে গিয়েছিল৷ অতীন তখন বিকম পাশ করে ফিনানশিয়াল অ্যাকাউন্টিং’এর একটা কোর্সে ভর্তি হয়েছে আর সেই পড়ার খরচ টানতে অনেক টিউশানি করে৷ প্রতিটা বাড়িতে গিয়েই ওর জলতেষ্টা পায় আর ঢোঁকে ঢোঁকে জল গেলার ফাঁকে ও ভাবতে থাকে, ওই ষাটটা লোক যে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে কোল্ড-ড্রিংক খেয়েছে বলে খবর পেল, সেই জলের পয়সা দিয়েছিল কে?

হিসেব মেলে না কিন্তু দিন থেমে থাকে না তাই বলে৷ ওর এক ছাত্রের বাবার রেফারেন্সে জীবনের প্রথম চাকরিটা পায় অতীন৷ তারপর সেই একটা থেকে আর একটায়, আবারও একটায়৷ বছর পাঁচ-ছয়েক পরে মা চলে যায় ক্যান্সারে৷ বোনের বিয়ে হয়ে গেছে ততদিনে৷ বাবাকে দেখবে কে, এই প্রশ্ণটা মায়ের মৃত্যুর চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় অল্পদিনেই৷ প্রশ্ণ নিজেও নিজের উত্তর খোঁজে তাই মিতালির সঙ্গে সম্বন্ধটা আসে৷ ছ’মাসেই মায়ের বাৎসরিক সেরে নিয়ে বছর ঘোরার কয়েকমাস বাকি থাকতেই মালাবদল হয়ে যায় অতীনের৷ গ্যাস-ওভেনের দায়িত্ব বদল হয় আসলে৷ বিয়ের চারদিনের দিন থেকেই হাঁড়ি-হাতা-খুন্তি মিতালির দখলে চলে যায়৷ মিতালি নাকি ভাল নাচত ধুনুচি হাতে নিয়ে, পাকাদেখার দিন শুনেছিল অতীন৷ কিন্তু বিয়ের পর থেকে কখনও কোনও নাচের কথা শোনেনি বলে, একদিন জিজ্ঞেস করেছিল মিতালিকে৷

---তোমার নূপুর নেই?

---আমার বাবা মরে গিয়েছিল ক্লাস এইটে থাকতে৷ আমি শুধু অষ্টমীর সন্ধ্যায় নাচতাম৷

মিতালির জবাব শুনে ওকে একটা নূপুর কিনে দেবার কথা ভেবেছিল কিন্তু তারপরই বুতান পেটে চলে এল৷

বুতানকে কোলে নিয়ে বাবার কথা ভাবত অতীন৷ আর দুটো মাস বেঁচে থাকলে লোকটা নাতির মুখ দেখতে পেত৷ অতীন অফিসে ছিল, মিতালিই শেষ জল দিয়েছিল বাবার মুখে৷ কিন্তু জলটা নাকি গড়িয়ে গিয়েছিল৷ গড়াতে গড়াতে কোথায় গিয়েছিল? কোনও সমুদ্রে?

বুতান ক্লাস ওয়ানে উঠেছে, একটা ইনক্রিমেন্টও হয়েছে অতীনের, ওরা এই বছরই একবার সমুদ্রে যাবে ভেবেছিল৷ বুতানের যখন তিনবছর তখন একবার পাহাড়ে যাওয়া হয়েছিল, প্রতি তিনবছরে একবার বেড়াতে যাওয়া মন্দ নয়৷ মিতালির মন হয়তো প্রতিবছরই বেড়াতে যেতে চায়, কিন্তু মিতালি তো আর চাকরি করে না৷ হ্যাঁ, চাকরি করে না জেনেই বিয়ে করেছিল অতীন কারণ তখন তো প্রায়োরিটি ছিল একটা হেঁসেল সামলানোর লোক৷ কিন্তু এখন তো বাবা নেই, এখন ছেলের ইংলিশ মিডিয়াম, এখন দিকে-দিকে ডবল-ইঞ্জিন সংসার৷ তাই প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে মিতালিকে দুটো-চারটে কথা শুনিয়েই ছাড়ে অতীন৷ একদিন কী একটা পুজো ছিল বলে সকালেই স্নান করবে ভেবেছিল মিতালি কিন্তু অতীনের ঝাঁঝালো কথায় সে ইচ্ছা জলাঞ্জলি দেওয়া ছাড়া অন্য রাস্তা ছিল না ওর৷ অতীন বলবেই বা না কেন? ন’টার আগে না পৌঁছলে, করপোরেট অফিস লাল দাগ দেবে না?সেই লাল দাগ একের জায়গায় একাধিক হয়ে যদি চাকরিটাই খেয়ে নেয়?তখন ভাত জুটবে কী করে?

---তুমি পুজো দিতে যাবে, না ধুনুচি নাচতে যাবে আমার জানার দরকার নেই৷ আমার স্নান হবার পর বাথরুমে ঢুকবে৷

রাস্তায় বেরিয়ে কথাগুলোর জন্য খারাপ লেগেছিল একবার৷ কিন্তু না বলে উপায় কী অতীনের?ওর বাইরে বেরনোটা তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই না?

অতীন ভেবেছিল৷

সবার বাইরে বেরনো বন্ধ হয়ে যাবার আগে৷

দুই
দেশবিদেশের ক্লায়েন্টরা কনফারেন্স বন্ধ করে দিতে শুরু করেছে এমনটা শুনছিল কয়েকদিন ধরেই কিন্তু কথাটা হাতুড়ির মতো মাথায় এসে পড়ল যখন মাসের শেষে মাইনের কুড়ি শতাংশ কম এল হাতে৷ ও তো খেটেছে সারা মাস, তাহলে কেন এখন প্রাপ্য টাকা থেকে এতটা কম পাবে? প্রশ্ণটা তুলতেই পারল না অতীন, যখন টের পেল যে মাঠেঘাটে ছুটে বেড়ানো ছেলেগুলোর কেউ কেউ অর্ধেক মাইনে পেয়েছে, কেউ বা আরও কম৷ আর এই মাসে যাও বা পাওয়া গেল, পরের মাসে তাও যাবে তো? খুব সম্ভব যাবে না কারণ আয় না হলে কোম্পানি ব্যয় করবে কীভাবে? তিরিশ টাকা দিয়ে একটা মাস্ক কিনে এনে তিন-চারদিন অফিস করেছিল অতীন, তারপর জানতে পারল যে আর অফিসে আসার দরকার নেই৷ ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ খুব ভাল ধারণা কিন্তু যেখানে ব্যবসাই তলানিতে ঠেকেছে সেখানে বাড়ি থেকেই বা কোন কাজ করবে? দু-চারদিন তাও ল্যাপটপের সামনে বসে কয়েকটা মেইল করে মন ভুলিয়েছিল কিন্তু ওপারের টেলিফোনটা যখন মৃত তখন এপার থেকে হাজার ডায়াল করেও লাভ হয় না কিছু৷

অতীনের সমস্ত ব্যস্ততা তাই রাস্তার মানুষজনের মতোই অন্তর্হিত হল৷ এবার রাস্তা থেকে থেকে মানুষ সরে গেলে যেমন কাঠবিড়ালিরা স্বচ্ছন্দে রাস্তা পারাপার শুরু করে, পাখিরা ফিরে আসে অচেনা দিগন্ত থেকে, ব্যস্ততা সরে গিয়ে জায়গা করে দেয় স্মৃতিকে৷ সে ফিরে আসে নিরুদ্দেশ কোনও বালকের মতো৷ তার সারা শরীরে ধুলো, মাথার চুলে আঠা কিন্তু একবার স্নান করিয়ে দিলে পরে আবারও সেই চিরচেনা মুখ৷

স্নানের সময়টা পালটে যাওয়ার ফলে, অতীনের সঙ্গে স্মৃতির মোলাকাতের পথ সহজ হল৷ ভাড়াবাড়িটা প্রোমোটিং’এর জন্য দিলে পুরনো ভাড়াটেদের দাবিও মেটাতে হয়৷ সেই সূত্রে অতীনদেরও কিছু প্রাপ্য হয়েছিল৷ কিন্তু অনেক টানাহ্যাঁচড়ার পরও যতটুকু জায়গা দিতে চাইছিল প্রোমোটার তাতে মানুষ থাকতে পারে, সংসার পারে না৷ অতীন তাই প্রোমোটারের দিক থেকে ইঙ্গিত পেয়ে দু’কিলোমিটার দূরের একটা প্রোজেক্টে ফ্ল্যাট নিতে রাজি হয়ে গিয়েছিল৷ কাকুরা খুব অসুন্তুষ্ট হয়েছিল ওর এই সিদ্ধান্তে, ওদের মতে এটা ‘ফেলে পালানো’ ছাড়া আর কিছুই নয় কিন্তু মানুষকে তো মানুষের জীবন ফেলেও একদিন পালাতেই হয়৷ মায়ের ক্যান্সার বাবার ব্যক্তিত্ব শেষ করে দিয়েছিল, বাবা সবকিছুতেই মাথা নেড়ে দিত অল্পে, এদিক-ওদিক দু’দিকের কথাতেই, এক্ষেত্রেও দিয়েছিল৷ সেইসব কথা, সেইসব বাধা পেরিয়ে অতীন একদিন নতুন ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারল, মায়ের মৃত্যুর পরপরই৷ একটা মেয়ে ছাড়া গৃহপ্রবেশ খুব ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে বলে ওইদিনই অতীনের বিয়ের কথা শুরু হয়েছিল৷ নতুন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে অতীন দেখেছিল সূর্যাথস্ত সম্পূর্ণ হবার আগেই আকাশে একটা চাঁদ উঠছে৷ তার গায়ের রঙের সঙ্গে টোপরের রং মিলে যায়৷ মিতালি জীবনে আসার পর কয়েকদিন সেই টোপরের রং’টা অক্ষত ছিল৷ তারপর আরও কত রং যে মিশল তাতে, একদিন দেখা গেল খাটের নিচে ইঁদুরে কাটা অবস্থায় টোপরটা পরে আছে৷ তখন আবার সেই ইঁদুর মারার বিষ কিনতে যেতে হল অতীনকে৷ সময় সবকিছু কেটে ছারখার করে দেয় কিন্তু সময়কে মারার কোনও বিষ পাওয়া যায় না৷ এমনটাই ভাবত অতীন, ভাইরাসটা আসার আগে৷

বাইরে না বেরনোর নির্দেশ দরজা বন্ধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়৷ সেই দরজা যখন ঘরের হয় তখন তার ভিতরে তবু তিনটে লোক থাকে কিন্তু যখন বাথরুমের হয় তখন ভিতরে লোক কেবল একটা৷

একটা মানুষের অসুখ অনেককে জড়িয়ে নিতে পারে, শুনছিলই অতীন৷ কিন্তু স্মৃতিও কি পারে নতুন কাউকে তার সঙ্গে যুক্ত করে নিতে?নইলে চতুর্থদিন মিতালি স্নান করে বেরিয়ে যাওয়ার পর ও কীভাবে বাথরুমের রেলিং’এ ঝোলা শাড়িটায় চন্দনের গন্ধ পেল? এই গন্ধটা ওর পুরনো বাড়ির মালিকদের দোতলার ঠাকুরঘর থেকে আসত৷ আড়ালে যাকে ‘বাড়িওয়ালি বুড়ি’ আর সামনে ‘ঠাকুমা’ বলত বাতের ব্যথায় কাতর সেই ভদ্রমহিলা সকালে অনেকক্ষণ ধরে এই চন্দন বাটতেন আর গন্ধটা আনমনা করে দিত অতীনকে৷ একবার পাড়ার পুজোর নাটকে ছোট একটা পার্ট পেয়েছিল অতীন৷ অন্তরা নায়িকা ছিল সেই নাটকের৷ অন্তরা ওর ঘামের গন্ধে বিরক্ত হবে, অনেকের মধ্যে ডিওডোর্যােন্ট না দেওয়া অতীনকেই ও চিহ্ণিত করবে এরকম কিছু ভেবে একদিন ঠাকুমার ঠাকুরঘর থেকে একটুকরো চন্দন চুরি করে এনেছিল অতীন৷ ওর একটা প্রিয় নীল হাফ-শার্ট ছিল তার বুকপকেটে ওটা ভরে সেদিন রিহার্সালে গিয়েছিল৷ মাত্র তিন-চার মিনিটের মঞ্চ উপস্থিতি, তার জন্য টানা তিনঘণ্টা ক্লাবঘরে থাকার কোনও প্রয়োজন ছিল না৷ তবু অতীন ছিল, যদি ওর বুকে লুকিয়ে রাখা সুগন্ধ অন্তরার নাকে যায়৷ কিন্তু, না ঘামের গন্ধ, না চন্দনের, অতীনের অস্তিত্বই খেয়াল করেনি অন্তরা৷ সে নয় করেনি, আজ ওই চন্দনের গন্ধ মিতালির ছেড়ে যাওয়া শাড়িতে কীভাবে এল? অন্য সময় হলে বাথরুমের ভিতর থেকেই মিতালিকে খেঁকিয়ে উঠত অতীন কিন্তু আজ স্নানের আগে আর পরেও ওই শাড়িটা মুখে চেপে ধরে অতীন ভাবতে থাকল, অন্তরার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ও যখন পকেটে চন্দন নিয়ে ঘুরছে তখন কী করত মিতালি? ভালবাসত অন্য কাউকে?

পরদিন স্নানে ঢুকতেই জুঁইফুলের গন্ধ৷ অতীনের মনে হল, মিতালি নিশ্চয়ই জুঁইফুলের গন্ধওয়ালা কোনও সাবান গায়ে মেখেছে কিন্তু সেরকম কোনও সাবান কোথাও নেই তো! মাইনে কমে যাওয়ার কারণে বোতলের বদলে ছ’টা শ্যাম্পুর পাতা কিনে এনেছিল অতীন, সেখানে গন্ধওয়ালা দামি সাবানের প্রশ্ণই ওঠে না৷ তাহলে জুঁই কীভাবে?

তার পরদিন মিতালি স্নান করে বেরোতেই, বুতান বাথরুমে যেতে চাইছিল কিন্তু ওকে প্রায় জোর করে ড্রয়িং খাতার সামনে বসিয়ে রেখে অতীন বাথরুমে ঢুকে গেল৷ মিতালি সাধারণত অতীনের সঙ্গে তর্কে যায় না তবে সেদিন প্রায় চল্লিশমিনিট পর অতীন বাথরুম থেকে বেরোলে ও জানতে চাইল, কেন একটা বাচ্চাকে এতক্ষণ কষ্ট দিল অতীন৷

---কষ্ট আবার কীসের?ওর কি প্যান্টে পায়খানা হয়ে যাচ্ছিল নাকি? আর সেরকম হলে ওকে ভোরবেলাই সব করে নিতে বলো না কেন, এখন তো আর সুকল নেই!

মিতালির চোখ বলছিল যে এখন তো অতীনেরও অফিস নেই কিন্তু ওর মুখ শুধু বলল, তুমি একটু পরে গেলেই বা কী হত?

কী যে হত তা মিতালিকে কীভাবে বোঝাবে অতীন? আজ কতদিন শরীর হয় না ওদের মধ্যে কিন্তু বিয়ের পরপর কিংবা বুতান হবার পরেও যখন চুম্বক আর আলমারির পাল্লার মতো সেঁটে থেকেছে ওরা, তখনও কই মিতালির ভিতর থেকে এইরকম গন্ধ পায়নি তো অতীন৷ আজ বালতির ভিতরে ডোবানো মগ কেবল জল নয় এত সুগন্ধ নিয়ে উঠে আসছে কী করে মিতালির স্নানের পরপরই?

পরদিন টয়লেট-ক্লিনার ব্যবহার করতে বলল মিতালি৷ এই কাজগুলো ও নিজেই করত কিন্তু এখন অতীন বাড়িতে আছে বলেই হয়তো সাহস পেল৷

---আমি ফিনাইল দিয়ে মেঝেটা...

---ফিনাইল?কেন? অতীন আঁতকে উঠল মিতালির কথার মধ্যেই৷

---ঢালব না? এখন তোমরা বাপ-ব্যাটা সারাদিন বাড়িতে, এরপর দুর্গন্ধ উঠবে তো!

মিতালির কথার কোনও জবাব না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল অতীন৷ আর তারপর৷

তিন
বাবাকে চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়ার মুহূর্তে যখন আগুন সর্বগ্রাসী হয়ে লাফিয়ে উঠেছিল চোখের সামনে তখন এই গন্ধটা পেয়েছিল অতীন৷ প্রথমে ভেবেছিল খাটিয়ার মধ্যে পড়ে থাকা ফুলগুলো থেকে গন্ধটা আসছে৷ কিন্তু বাবার বডিতে কেউ তো ওই ফুল দেয়নি, দিতে পারে না৷ তাহলে গন্ধটা কোত্থেকে আসছে?

আজ মোবাইলটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়েছিল অতীন৷ অন্যমনস্ক ছিল, হতাশও৷ মিতালি যখন ফিনাইল ঢেলে গেছে তখন আজ আর কিন্তু আজই গন্ধটা এল৷

অবশ্য গন্ধের আগে একটা মেসেজ এসেছিল অতীনের মোবাইলে৷

তাতে এটুকুই বলা ছিল যে কোম্পানি আপাতত ঝাঁপ বন্ধ না করলেও ঘুমঘোরে চলে যাবে৷ আর তাই আগামী দু’মাস মাইনের পঁচিশ শতাংশ করে দিয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলা হবে৷ পরে আবার সুদিন ফিরলে...

মেসেজটা পরার পরপরই অতীনের মনে হল হাসনুহানার গন্ধটা নাকে লাগছে৷ সেদিন শ্মশানে যেমন লেগেছিল৷ না, আজ কোনও শাড়ি ঝুলে নেই মিতালির৷ কিন্তু সামনের প্লাস্টিকের বড় বালতিটা জলে টইটম্বুর হয়ে উঠেছে৷

চারটে জীবনবিমার প্যাকেজ মিলিয়ে প্রায় পনেরো লাখ টাকা পেয়ে যাবে মিতালি আর বুতান৷ অসুখ পার করেও ছেলেটার বড় হওয়া পর্যন্ত
হার্ট অ্যাটাক হিসেবে প্রমাণ না করতে পারার কোনও কারণ নেই৷ ও বাথরুম থেকে না বেরোলেই মিতালি এই পলকা প্লাইউড ভেঙে ঢুকে ওর মাথাটা কোলে নেবে৷ তারপর, বাথরুমে অতীন কীভাবে মরে ছিল সেটা বলে ফেলার মতো বোকামি নিশ্চয়ই করবে না!

হাসনুহানার গন্ধটা আজ পাগল করে দেবে৷ শ্মশানে গন্ধটা এত তীব্র ছিল না৷

বালতির জল উপচে পড়ছে৷ মিতালি কি মুসুরির ডালে শুকনো লংকা দিল?

কিন্তু এই বালতির ভিতর কোনও ঝাঁঝ পৌঁছবে না৷

বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে নিজের গলা অবধি ডুবিয়ে দিল অতীন৷

কিন্তু গন্ধটা তো জলের মধ্যে নেই!

তাহলে কি গন্ধটা আসলে মৃত্যুর ছিল না?বাবাকে নিয়ে শেষবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার আগে ও যে মিতালির উঁচু হয়ে থাকা পেটে মুখ রেখেছিল সবাইকে লুকিয়ে, গন্ধটা সেখান থেকেই সঙ্গে লেগেছিল?

বুতান কি ওর ঘরের ভিতর থেকে ডাক দিল বাবাকে?

মিতালির ডাল নেমে গেছে?

কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তো ঘোড়াগুলো উড়তে শিখতে পারে?

এক পাঁচ দশ সেকেন্ড৷

গন্ধটা তারস্বরে ডাকছিল অতীনকে৷ নীরবে৷

অতীন বালতির ভিতর থেকে মাথা তুলে নেবে ঠিক করল৷

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.