প্রবন্ধ

প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ – পাওয়া, না-পাওয়া, ছেড়ে যাওয়া

রবীন্দ্রনাথ – পাওয়া, না-পাওয়া, ছেড়ে যাওয়া

লেখক : পবিত্র সরকার

যে-কথাটা আমাদের সকলেরই মনে হয়, তা হল, রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার জন্য আমাদের কোনোরকম চেষ্টা করতে হয়নি৷ পাওয়া মানে বাংলাভাষায় পাওয়া৷ প্রাকৃতিক কার্যকারণ ও অণু-পরমাণুর কোন্ অভাবিত যোগাযোগে এই মানূষটি বাংলাভাষার কবি ও স্রষ্টা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা আমরা কেউ জানি না৷ ফলে আমরা যারা পৃথিবীর যেখানেই থাকি, কিন্তু বাংলাভাষা ব্যবহার করি, তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ এক হাতে-পাওয়া সম্পত্তি৷ এর জন্য আমাদের কোনো কষ্ট করতে হয়নি, সাধনা করতে হয়নি৷ তিনি আমাদের জন্মগত উপার্জন৷ সম্পত্তি, উপার্জন--- কিন্তু আমরা কতজন সেটা জানি, বুঝি?কতজন সেটা অন্যদের বোঝাবার জানাবার দায়িত্ব নিই? একদিকে আছে বিপুল- সংখ্যক নিরক্ষর বাঙালি, বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, আসাম, ঝাড়খণ্ড, বিহার আর অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে, যারা মুদ্রিত রবীন্দ্রনাথকে এখনও চেনার সুযোগই পায়নি৷ অথচ মুদ্রিত রবীন্দ্রনাথই এখন পরিমাণগরিষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ, তাঁকে না জানলে কিছুই জানা হয় না৷ ‘গানের ভিতর দিয়ে’ তাঁকে শ্রুতিতে হয়তো কিছুটা পাওয়া যায়, কিন্তু গানের রবীন্দ্রনাথ পুরো রবীন্দ্রনাথ নন৷ নিরক্ষর মানুষেরা চলচ্চিত্র নাটকে দৃষ্টির রবীন্দ্রনাথকেই বা কতটা পায়, তাঁর ছবি থেকেই বা কতটা ধরতে পারে তাঁকে, যদি দেখার সুযোগও পায় ছবি? এখনও অক্ষরমাধ্যমের রবীন্দ্রনাথই আমাদের কাছে আসল রবীন্দ্রনাথ, যে-রবীন্দ্রনাথকে আমরা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি৷ এ দায় ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রের৷

ফলে নিরক্ষর যে-মানুষ রবীন্দ্রনাথকে পেল না, সে অপরাধ তার নয়৷

কিন্তু সাক্ষর হলেই মানুষ স্বতঃসিদ্ধভাবে রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে যাবে, ঘটনা তো এমনও নয়৷ সাক্ষরতারও নানা স্তর আছে, মাত্রা আছে৷ আমরা কেউ কেউ সুকলে-কলেজে পাঠ্যতালিকায় রবীন্দ্রনাথকে পাই, পড়ি, পরীক্ষা দিই, কিন্তু সবাই কি তাকে সঙ্গে নিয়ে আসি বাকি জীবনের জন্য, যেমন করে ‘পান্থজনের সখা’ হিসেবে তাঁকে আঁকড়ে ধরেছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব? চিরপথের সঙ্গীর মতো, চিরজীবনের মতো?

আইয়ুবের ব্যক্তিগত রবীন্দ্র-সন্ধানের সঙ্গে আমাদের কারও তুলনা হয় না৷ তিনি অন্য ভাষার মানুষ, উর্দুতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে মনে হল মূল বাংলায় এই কবির কবিতা পড়া দরকার, বাংলা শিখলেন, রবীন্দ্রনাথকে তন্ন তন্ন করে পড়লেন, বুঝলেন, বোঝালেন কেন তিনি আমাদের জীবনের মর্মে বসে দোলা দিয়ে চলেছেন, নিজের সুখদুঃখকে দেখতে শিখলেন রবীন্দ্রনাথের আলোকে৷ তবু আমাদের কারও কারও আছে এ ভাবে রবীন্দ্রনাথের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়ার ব্যক্তিগত ইতিহাস৷ শহর থেকে অনেক অনেক দূরের গ্রামের ছেলে বা মেয়ে, বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের নাম ছিল প্রায় অশ্রুত, কিংবা নেহাতই এক অস্পষ্ট জনশ্রুতির মতো৷ সে সুকলে বা কলেজে পড়ল রবীন্দ্রনাথ, কিংবা তাঁর গান শুনে তার মনে তোলপাড় জাগল কোনো মুহূর্তে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার দিনরাত্রির রং একেবারে বদলে গেল৷ সে ভাবল, আমার আর যাই চাই, আর যাই পাই বা না পাই, ইনি আমার এক বড়ো সম্বল, এঁকে ছাড়া চলবে না আমার বাকি জীবন৷ রবীন্দ্রনাথ আমার ‘একটিমাত্র গোপন কথার মতো’ নন, তিনি হবেন আমার গলার হার, আমার মাথার মুকুট৷

আমার কথায় হয়তো একটু উচ্ছ্বাসের সুর লাগছে, কিন্তু দুই বাংলায় অনেক মানুষ ছিলেন এবং এখনও আছেন, যাঁরা রবীন্দ্রদীক্ষায় দীক্ষিত, রবীন্দ্র-সংসৃকতিতে নিষ্ণাত৷

একসময় কেউ কেউ ভাবতেন, রবীন্দ্রনাথ পুরুষের পৌরুষকে দুর্বল করেন, তাঁর কাছ থেকে শুধু পেলবতা আর কোমলতার পাঠ নেয় সকলে৷ এ কথা এক বেমালুম মিথ্যে কথা৷ বজ্রে তাঁর বাঁশি বাজে, তাঁর গান সহজ নয়, এ কথা আমরা পরে বুঝতে শিখেছি৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের সেই বজ্রসত্ত্ব রূপ দেখেছিল বাঙালি, তিনি ছিলেন মুক্তি সংগ্রামের আর-এক সেনাপতি৷ তাঁর ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ গান গেয়ে বাঙালি বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত যেমন অক্লেশে নিজের ফাঁসির আদেশ শুনেছেন, তেমনই ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবী নিয়ৎ-ও স্বৈরাচারী শাসকের হত্যাবাহিনীর উদ্যত রাইফেলের সামনে পরম আবেগে আবৃত্তি করে উঠেছেন, ‘আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে, ডাক দিয়ে যায় নূতন পাতার দ্বারে দ্বারে৷’ প্রথম মহাযুদ্ধের শেষলগ্ণে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়াত ইংরেজ কবি উইলফ্রেড আওয়েন-র ডায়েরিতে পাওয়া গেছে রবীন্দ্রনথের এই পঙ্ক্তিগুলির ইংরেজি অনুবাদ, ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই, যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই৷’

এই সব অসমসাহসী মানুষকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গান গভীরভাবে উদ্দীপ্ত করেছে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদেরই মতো৷

কাজেই রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া মানে সন্ন্যাস নেওয়া নয়, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়, কাপুরুষতায় দীক্ষাগ্রহণ নয়৷ রবীন্দ্রপাঠ সেখানে হয়ে ওঠে বৃহৎ জীবনপাঠের নামান্তর, যে জীবন জীবনকে আরও প্রগাঢ়ভাবে, তীব্রভাবে অনুভব করতে শেখায়, যে জীবন ‘দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে’ ব্রতী হতে শেখায়, যে জীবন মৃত্যুকেও তুচ্ছ করতে শেখায়--- ‘মরতে মরতে মরণটারে, শেষ করে দে একেবারে৷’

সারা পৃথিবীতে কত মানুষ এসেছেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, তাঁর কাছে জীবনপাঠ নেবেন বলে৷ তাঁর ইংরেজি রচনার স্প্যানিশ অনুবাদকর্মে দীর্ঘদিন ব্যাপৃত ছিলেন ওই ভাষার কবি হুয়ান রামোন হিমেনেথ, যিনি নিজেই পর নোবেল পুরস্কার পান৷ যে লাইব্রেরিতে বসে তিনি রবীন্দ্রনাথ পাঠ আর অনুবাদ করতেন, সেই একই লাইব্রেরিতে আর-একটি রবীন্দ্রানুরাগী মেয়ে জেনোবিয়া কাম্পুরাবি একই কার করত বসে বসে, সেও কবি, পরে হিমেনেথের জীবনসঙ্গিনী হয় সে৷ স্প্যানিশভাষী বিশ্বে এখনও রবীন্দ্রনাথ ঘরে ঘরে উচ্চারিত এক নাম৷ সেখানে ছবি-পোস্টকার্ডে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছত্র ছাপা হয় স্প্যানিশে, নোবেল পুরস্কার-প্রাপ্ত ঔপন্যাসিকের চরিত্রের ঘরের দেওয়ালে বাঁচানো থাকে রবীন্দ্রনাথের বাণী৷ তুরস্কের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এজভিত অনুবাদ করেন গীতাঞ্জলি, আমেরিকার মৃত্যু-বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শ্রীমতী এলিজাবেথ কুবলার রস্ তাঁর ‘অন ডেথ অ্যান্ড ডাইইং’ বইয়ে তেরো জায়গায় শুধু একজনের লেখা থেকেই উদ্ধৃতি দেন, শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের৷ এ যুগের মহাকাব্য রচয়িতা ফরাসি কবি সঁ ঝঁ পের্স তাঁর নিজের নোবেল-পুরস্কার ভাষণে রবীন্দ্রনাথেরই কথার পুনরাবৃত্তি করেন, যার চেনারূপ হচ্ছে, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও৷’

এ তো অন্য ভাষার মধ্য দিয়ে তাঁকে পাওয়া, কতটুকু পাওয়া গেছে কে জানে৷ তবু যা তাঁরা পেয়েছেন, তাতেই তাঁদের অসামান্য চরিতার্থতার কথা বারবার বলেন তাঁরা৷ আমাদের তো সেই কষ্টটুকুও করতে হয় না, আমরা কোনো সাধনা না করেই তাঁর ভাষার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি৷ আমাদের অনেকের মতে এ এক অভাবিত অলৌকিক সৌভাগ্য৷ যাঁরা ভাগ্য কথাটা তত পছন্দ করি না তার বলতে পারি এ এক অবিশ্বাস্য যোগাযোগ৷ এ কী করে সম্ভব হল তার কোনো ব্যাখ্যা আমাদের কাছে নেই৷ এর জন্য আমাদের ঈর্ষা করবার লোকও প্রচুর৷

তাই সে রকম বেশ কিছু লোক প্রাণপণ বাংলা শিখেছেন মূল রবীন্দ্রনাথকে পড়বার জন্য৷ জাপানের ওয়াতানাবে থেকে কাজুয়ো আজুমা, আমেরিকার এডোয়ার্ড ক্যামেরন ডিমক, চেকোস্লোভাকিয়ার দুশান জ্বাভিতেল, জার্মানির মার্টিন কেম্পশেন, ইংল্যান্ডের দুই কবি উইলিয়াম যাডিচে আর জো উইন্টার, চিনের দং, লাতভিয়ার ভিক্তর ইভঁবুলিস--- সকলেই বাংলা থেকে নতুন করে অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের, নতুন সময়ের ভাষার রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের ভাষার পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য৷ এ তো শুধু বিদেশিদের কথা, এই দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে এদের সংখ্যা হাজারের কম নয়৷ তারা আছে অস্ট্রেলিয়ায়, আছে শ্রীলঙ্কায়, আছে ইন্দোনেশিয়া মালেশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে৷

এর মধ্যে আমরা বাঙালিরাই কি শুধু বাংলা ভাষাকে আর সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে যেতে চাইব?রবীন্দ্রনাথকে, লালনকে, হাসন রাজাকে, নজরুলকে, বঙ্কিম-মোশার্রফ-শরৎ-তারাশঙ্কর- বিভূতিভূষণ-জসীম উদ্দীন-শামসুর রাহমান-আখতারউজ্জামান ইলিয়াসকে? আমাদের ছেলেমেয়েদের বাংলাভাষা পড়তে উৎসাহ দেব না, মাতৃভাষা ভুলে গেলে তবে অন্য ভাষা, জীবিকা ও ঐশ্বর্যের ভাষা ভালো শিখতে পারবে এই ভ্রান্ত বিশ্বাস মনের মধ্যে অন্ধ আর অশিক্ষিতের মতো পুষে চলব? আমাদের ভাষায় আমাদের জীবনের গভীরতম অনুভূতিগুলির কথা আর সুরের প্রকাশ বুঝে নেবার চেষ্টা করব না আর, বর্জন করতে চাইব বাঙালি সংসৃকতির সবচেয়ে মূল্যবান উত্তরাধিকারকে?

হয়তো প্রতিটি পঁচিশে বৈশাখ এই অস্বস্তিকর প্রশ্ণটাকেও তুলে ধরে আমাদের সামনে৷

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.