গল্প জীবনের খণ্ডচিত্র
সে দিনটা ছিল আমার প্রথম চাকরি করতে যাওয়ার প্রথম দিনের কথা। স্বাভাবিক ভাবেই রাতে ভালো ঘুম হয়নি নিরানন্দ আর হতাশায় তৈরি হওয়া অদ্ভুত এক মানসিক যন্ত্রণায় জেরে। আশ্রম টাইপ জুনিয়র হাই স্কুলের মাস্টারি। জলপাইগুড়ির ধাপগন্জে। হলদিবাড়ি যাওয়ার পথে বড় রাস্তার পাশেই সে স্কুল।
বাবার বুক থেকে যেন এক জগদ্দল পাথর নেমে গিয়ে মনে বিরাজ করছে এক পরম নিশ্চয়তা। যা হোক একটা কিছু তো হয়েছে ছেলেটার। আমার মা তার ছেলেদের নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। এই ছোট চাকরি তার পছন্দ না হলেও আজ তার মুখেও এক রুপালি রেখা। ভাবখানা এমন যাক আমার বেকারত্ব তো ঘুচলো। একমাত্র আমারই মন খারাপ। বন্ধুরা সব ভালো ভালো চাকরি করছে, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার তো আছেই, সরকারি চাকরিতে কেউ উচ্চপদে চাকরি করছে কেউবা করবে করবে করছে। আমিও প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এমন সময়েই এ মাস্টারির অ্যাপয়েনটমেট লেটার। যা হোক ওই সামথিং ইজ বেটার দ্যান নাথিং।
বাড়ির গেটের কাছে জযনালের রিকশা এসে হাজির। মনে জোর আর মনখারাপ নিয়ে মায়ের দেওয়া ট্যাঙ্কটা নিয়ে উঠে পড়লাম রিকশায়। শুনতে পেলেন বাবা মাকে বলছে নতুন মশারিটা গুছিয়ে দিয়েছো তো? ম্যালেরিয়া ট্যালেরিয়া আবার বাধিয়ে না বসে। সারাদিন ধরে শুধু ক্যাপটানি করা এবার বের হবে। দেখো মুখটা কেমন ব্যাজার করে আছে।
বুড়িদি, মনজুদি, নার্স পিসিরা বাদলদারা বাইরে এসে দেখতে লাগলো আমার চাকরি করতে যাওয়ার মূহূর্তকাল। এদের মধ্যে বুড়িদির সবচেয়ে বেশি মনখারাপ। আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললো “ভাই, বাড়ি আসবিনি আজ? ‘আমার চোখে জল আসবো আসবো করছে কিন্তু লজ্জায় তা ফেলতে পারছি না। আমি গ্রামেরই ছেলে, তবু আমি যেখানে যাচ্ছি সে আরও এক অজানা পাড়া গাঁ, সেখানে প্রাতঃকৃত্য করতে হয় নদীর ধারে। আমার নিজের একটা খেলার টিম আছে, চার পাঁচটা খেলার দিন ঠিক হয়ে আছে বিভিন্ন দলের সাথে। আমার আর সেগুলো খেলা হলো না। আর হ্যাঁ যাবার সময় টুনির সাথে দেখা হলো না। বুড়িদি তাকে শাসিয়ে রেখেছে বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে। আমিও এদিক ওদিক তাকালাম। একজোড়া চোখ জানালার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখছে, আমিও তা দেখতে পেলাম। ওই এক পলকের একটু দেখা আর কি। তাকে ঠিক দেখা হওয়া বলা চলে না।
সাঁই সাঁই করে রিকশা চালাচ্ছে জয়নাল। অনেকটা পথ যেতে হবে। হলদিবাড়ি যাবার পথে কোথাও এক ধাপগন্জে। সেখানে আজ আমার চায়ের নিমন্ত্রণ। ক্রিকেট খেলতে কতবার গেছি এই পথে। স্কুলটা কোনোদিন চোখেও পড়েনি।
অনেক আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে যাওয়া হল সেখানে। বিরাট এক মাঠ পেরিয়ে আমার স্কুল। রিকশায় বসা এই নবাগতকে দেখে দৌড়ে আসলো অনেকগুলো ছাত্র হৈ হৈ করতে করতে। মাস্টার এসেছে মাস্টার এসেছে। মাস্টার এসেছে কথাটা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। জয়নালের ভাড়া মেটাবার আগেই দেখলাম দুটো ছেলে আমার ট্রাঙ্ক নামিয়ে একটা ছোট ঘড়ের সামনে রাখলো। “স্যার, এই নিন ঘড়ের চাবি।” হেড মাস্টার বলেছেন আপনি আজ আসবেন, তাই চাবিটা আমার কাছে দিয়ে রেখেছেন। আমি ক্যাপ্টেন। আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোমরা স্যার কে মাস্টার বলছো কেন? বলতে হয় মাস্টার মশায়। মনে থাকবে তোমার? সবাইকে এ কথাটা বলে দাও।” মনে হয় চমকে উঠলো ছেলেটা। একটু ভয়ও পেল বোধহয়। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলাম। একেবারে জীবনের প্রথম চাকরির প্রথম দিন। কারও মন খারাপ হোক আমি তা চাই না।
একটু পরে স্কুলের সকলের সাথে আলাপ হলো। সরাসরি এক ভদ্রলোক আমার সাথে করমর্দন করে বললো আমার নাম শ্যামল সেন, সহকারী শিক্ষক, ওই পানডাপাড়ায় বাড়ি। এই ভদ্রলোকের সাথে তখনই আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। বহুদিন তার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। শ্যামলদার কাছ থেকেই আমি স্কুলের যাবতীয় কার্যকলাপ জেনে গেলাম। এ স্কুলের সব ছাত্রই আবাসিক। তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের নিয়ে গড়া এই বিদ্যালয়ে শিক্ষা ও খাওয়া জোটে সরকারি খরচে। থাকাও ফ্রি। ক্লাস ফাইভ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শ্রেণি কক্ষেই তাদের শোবার জায়গা। হ্যারিকেন ও বিছানা আনতে হয় নিজেদের। ইলেকট্রিক লাইট অনেকদূর পর্যন্ত কেউ চোখেও দেখেনি। যতদূর চোখ যায় গ্রামবাসীদের ঘরে ঘরে সব কুপি অথবা হ্যারিকেনের আলো। নিস্তব্ধতার নিবিড়ে ঢাকা ধাপগন্জ গ্রাম যেন এক প্রেতপুরী। কোথাও কোনো কোলাহল নেই। শুধুমাত্র কয়েকজন ছাত্র ডাক ছেড়ে পড়ছে। আমি তাদের কাছে গিয়ে পড়া বুঝিয়ে দিলাম। দমকা এক বাতাস শীত শীত করছে শরীর।
অচেনা পরিবেশে অচেনা বিছানায় আমার ঘূম আসলো না। মধ্যরাতে দমকা বাতাসে জানালার পাল্লা গেল খুলে। মায়ের দেওয়া চাদরে মুখ ঢাকা দিয়ে পড়ে রইলাম মৃতবৎ। হে ভগবান এ আমি কোথায় আসলাম চাকরি করতে? চাকরিতে প্রথম দিন ও রাতটা কাটলো আমার নানা অভিজ্ঞতায়। সকালে ঘুম ভাঙলো গ্রাম্য নারীদের কোলাহল আর স্কুলের কলে জল নেবার শব্দে।
এ স্কুলে আমি চাকরি করেছি প্রায় বছর দেড়েক। ছাত্রদের নিয়ে নানা অনুষ্ঠান, ফুটবল খেলা, ভলিবল খেলা, কালিঝোড়ায় পিকনিক সবই করেছি ভালোবেসে। স্কুলের প্রতিটি ছাত্র আমায় ভালোবাসতো প্রায় পাগলের মতো, তবুও আমি তাদের ছেড়ে এসেছি কিছুটা চাপে এবং কিছুটা নিজের ইচ্ছায়। আমার তখন অন্তত চার পাঁচটা ভালো চাকরি পাবার যোগ্যতা তৈরি হয়েছে। দিলীপের বাবার মুখে মিষ্টি আর গা-জ্বালানো বাক্যটি আমি কোনদিন ভুলতে পারিনি। “কিহে বাপু, শেষমেশ ক্লাস এইটের ওই ডোবায় তুমি ডুবে মরলে?” তোমার দাদা এত বড় চাকরি করে, ভাই ইউনিভার্সিটির ভালো ছাত্র, বাবা এতবড় ডাক্তার, যাকগে যার ভাগ্যে যা জোটে তাকে সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কি বলো? আসলে দিলীপই আমাদের গ্রামের প্রথম ছেলে যে নাকি স্টেট ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে, তার বাবার তো একটু অহংকার হবেই। দিলীপের চাকরির কথা শুনে আমার বাবা খুবই খুশি হয়েছিলেন কিন্তু আমার দিকে ও তাকিয়ে ছিলেন অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে। সে দৃষ্টি র অর্থ আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি। সেজন্যই আমি অন্য চাকরির লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। চাকরি যদি করতে হয় তবে ঐ স্টেট ব্যাংকই করবো। অনেকের এখানে আমার এটা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে তবুও এটা সত্যি। দিলীপের বাবা হয়তো জানেন না ময়নাগুড়ি হায়ার সেকেন্ডারি বয়েজ স্কুলে আমিও প্রথম চার পাঁচ জনের মধ্যে ছিলাম। আর মাস্টারমশাইরা আমাকে ভালোবাসতো দিলীপের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। দিলীপের বাবার একসময় আমাকে পড়িয়েছিলেন। খুবই ভালো মানুষ তিনি। আমার বাবার বন্ধুও বটে।
যা হোক যে স্কুলের কথা বলছিলাম তা আর একটূ বলি। সরকার বাহাদুর ঠিক করেছেন অবৈতনিক এই স্কুলের ছাত্রপিছু খাবার খরচ একটাকা বিয়াল্লিশ পয়সা, হ্যাঁ প্রতি মিলে। হাভাতে ঘড় থেকে উঠে আসা এই ছেলেগুলো শুধু স্কুলমুখী হয় খাবারের প্রত্যাশায়। সকাল দশটায় এবং রাত আটটায় বিজয়বাবুর ঘণ্টা শুনে শুরু হয় দৌড় প্রতিযোগিতা। “বিজয়দা আজ ডিম হয়েছে”? কিছুটা ধূসর বিবর্ণ চেহারার ছেলেদের মুখে হাসি বেড়ে যেত খাবার পাতে ডিম বা মাছ থাকলে।
স্কুলের করনিক রায়বাবুকে সাথে নিয়ে একদিন আমি দেখা করতে গেলাম এস আই এর সাথে, ঐ সৌজন্য সাক্ষাৎকার আর কি। তিনি আমাকে দেখে বললেন কি কেমন চলছে আপনার? ছাত্ররা সব পড়াশোনা, খাবার পাচ্ছে তো? আমি যথাসম্ভব বিনয়ের সাথে বললাম, স্যার, ভালো করে খাওয়া না জুটলে পড়বে কি? মিল প্রতি টাকাটা একটু বাড়াবার চেষ্টা করুন। এত অল্প টাকায় পেটভরে খাবার দেওয়া যায় না স্যার। এস আই ভদ্রলোক আমার দিকে কটমট করে তাকালেন। আমিও এতটুকু ভীত না হয়ে বললাম, স্যার ছেলেদের প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য কয়েকটা ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়, আর স্নানের জন্য চাই একটা ঘর। অনেকেই নদীতে যায় চান সারতে। বৃষ্টিতে নদীর ঢেউ কিন্তু উথালপাতাল। কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না। তা ছাড়া সাঁতার জানে না অনেকেই। ভদ্রলোক এবার তেড়েফুড়েঁ উঠে বললেন দুটো কল করে দেওয়া আছে, ছেলেরা নদীতে যাবে কেন? নদীতে স্নানে যেতে বারণ করুন। তারপর একটু থেমে বললেন “ঠিক আছে আমি দেখছি, কি করা যায়।”
আমি ভাবলাম কথাটা ঠিক, আর কথা বাড়ালাম না। হ্যাঁ, দুটো কল দেওয়া আছে ঠিক তবে তার একটা অকেজো, আর একটা কলে গ্রামের মেয়ে বৌরা হাঁড়ি কলসি নিয়ে যখন তখন জল ভরতে আসে। তাদের না বলা যায় না। জলের নাম জীবন। কল খুলে ঘণ্টাখানেক ধরে স্নান সারার জীবনে অভ্যস্ত ভদ্রলোকেরা এ-সমস্যা কোনোদিনই বুঝবে না। বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী আমিও দেখলাম কি চরম অবহেলায় জর্জরিত হতে হয় এক বিশেষ সম্প্রদায়কে। তোমাদের বড় লোলা, বিনে পয়সায় খাবার পাচ্ছো তাতেও মন ভরে না? আর কত?
স্কুল থেকে একটু দূরে শনিবার করে হাট বসে ধাপগন্জে, সেখান থেকেই তরিতরকারি মাছ এবং প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয়। শ্যামলদা, বিজয়দা এবং আরও কয়েকজন ছাত্র মিলে বাজার সারি। ছেলেরা মাংসের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিজয়দা বলে ওদিকে তাকাসনা, সামনে মাসে স্যারকে বলে একদিন ব্যবস্থা করবো। যা হোক তৃতীয় মাসের বেতন পেয়ে আমি সব ছাত্রদের বললাম আজ স্কুলশেষে তোমরা আমার সাথে হাটে যাবে। মহা উৎসাহে ছাত্ররা আনন্দে লাফাতে শুরু করলো। হাটে এসে আমি ছাত্রদের বললাম তোমরা আজ নিজের ইচ্ছামতো খাবার খাও। হ্যাঁ যত খুশি। কেউ লজ্জা পেয়ো না।
ছাত্ররা কেউ খেলো মিষ্টি, কেউ আইসক্রিম, কেউ ফল, কেউ চা পাউরুটি, কেউবা আবার কেওড়া দেয়া শরবত। হাটে উপস্থিত অনেক সন্মানীয় ব্যক্তিরা যারা আমাকে এতদিনে চিনে ফেলেছে তারাও বলতে শুরু করেছে “দেখছেন সরকারের পয়সার কি বেহিসাবি খরচ?” আমি গ্রামের লোকদের চিনি তাই তাদের কথায় মন খারাপ করিনি। আটশো বাইশ টাকার মাস মাহিনায় সেদিন আমার মেরে কেটে খরচ হয়েছিলো দুশো টাকার কাছাকাছি। কিন্তু যে শান্তি আমি সেদিন পেয়েছিলাম তা আমার পক্ষে বর্ণনা করা সাধ্যাতীত।
একদিন গ্রামেরই একটি মেয়ে রাতের দিকে তার ভাইকে নিয়ে আমার কাছে হাজির। সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। মাথানত করে বললো, স্যার, আমাকে একটু অঙ্ক আর ইংরেজিটা একটু দেখিয়ে দেবেন? আমি কিন্তু টাকা পয়সা কিছু দিতে পারবো না। স্পষ্ট উচ্চারণে, সোজা সরল আবেদন। রাতেরবেলায় অজানা একজন মানুষের ঘরে ঢুকে এমন কথা বলা যায় তা আমি এই মেয়েটাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। হ্যাঁ, আমি আমার ছাত্রদের সাথে তাকেও কিছুদিন পড়িয়েছিলাম। সে অসম্ভব মেধাবী। বাবা পাইকারি হাটে দালালি করে। তার ইচ্ছে সে বড় হয়ে নার্স হবে।
স্কুল ছেড়ে যেদিন আমি আমার একমাত্র সম্বল ট্যাঙ্ক নিয়ে হাসিমারার উদ্দেশ্যে রওনা দিই সেদিন বিদায়কালে সেও আমার ছাত্রদের সাথে উপস্থিত ছিলো। কালো হরিণ চোখে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল “স্যার, আপনিও চলে যাচ্ছেন?” শুনেছি সম্প্রতি তার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। কোনো এক অনামী নার্সিংহোম কিংবা সরকারি হাসপাতালে সে চাকরি করছে কিনা তাও আমার অজানা।
তারপর পার হয়ে গেছে প্রায় তিন দশক। আমি এখন স্টেট ব্যাংকের এন এস রোডের ম্যানেজার। চাকরির শেষদিকে। কলকাতা পুলিশের সাথে আমাদের টাইআপ। মোদ্দাকথা তাদের পারসোন্যাল লোন এবং আরও কিছু সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়। পুলিশের ছোট বড়ো চাকরিজীবী সকলকেই। একদিন এক দীর্ঘদেহি পুলিশ অফিসার আমার সামনে এসে হাজির এবং তিনি দাঁড়িয়ে আছেন অনেকক্ষণ ধরে। আমি ভদ্রলোককে বললাম, আপনি ওই মৌসুমী দেবীর কাছে যান। লোন বিষয়ে কথাবার্তা ওখানেই হয়। পরে আমি দেখি। ভদ্রলোক তাও মাথানীচু করে দাঁড়িয়েই থাকলো। এক সময় বললো স্যার, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। এত কাজের মধ্যে আবার কি কথা, একটু বিরক্ত হলাম বৈকি। তারপর চমকে উঠলাম তার একটা কথা শুনে, স্যার, আপনি ধাপগন্জে ছিলেন না? আমি ললিত লাকরা।
আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভেসে উঠলো অতীতের কিছু ঘটনা। স্কুলের আলমারি থেকে চুরি হয়েছে প্রায় তিনশত টাকা। রাতের অন্ধকারে এ কাজ স্কুলের ছাত্র ছাড়া কারও পক্ষে করা অসম্ভব। নাইট গার্ডকে ডেকে হেডমাস্টার মশায় বললেন, আপনি কি পাহারা দেন মশাই? হয় চোর ধরুন নতুবা আপনার অপদার্থের কথা আমি হেড আপিসে রিপোর্ট করবো। স্কুলের ম্যানেজমেন্ট কমিটির সকলে একবাক্যে বললো, এমন চুরি মেনে নেওয়া যায় না। চোর ধরাও পড়লো, টাকাও ফেরত পাওয়া গেল। হেড মাস্টার মশায় নাছোড়বান্দা চোরকে স্কুলছাড়া করেই ছাড়বে। দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা হচ্ছে? মনে আছে আমি চোরের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। অনেক অনুনয় বিননয় করে চোরকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা থেকে বিরত করলাম। মনে আছে হেড মাস্টার মহাশয় অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন আমার উপর। আমি বললাম, চোর চুরি করেছে ঠিক তবে তা নিজের জন্য করেনি। চোরের ছোট বোন হাসপাতালে ভর্তি। তার হার্টে ফুটো আছে। চিকিৎসার জন্য টাকা প্রয়োজন। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি কথাটা একশো শতাংশ সত্য। তবে মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা ছিলই, “কাজটা কি ঠিক করলাম?” অনেকদিন ধরে, তারপর সময়ের সাথে সাথে ভুলেও গিয়েছিলাম।
ললিত লাকরা মাথানত করে এখনও বসে আছে আমার টেবিলের পাশে। “স্যার, আপনাকে আমি অনেক খুঁজেছি, টেবিলের উপর আপনার নাম লেখা দেখেই বুঝতে পেরেছি, আপনিই আমার সেই ধাপগন্জের স্যার। সেদিন আপনি আমাকে না বাঁচালে আমি আজ পুলিশ অফিসার হতে পারতাম না তবে আমার বোন বাঁচেনি স্যার। আপনার কথা মেনে কখনও আমি আর চুরি করিনি। এখন আমি চোর ধরি স্যার।”
তারপর ললিতবাবু সোজা হয়ে স্যালুট ঠুকলো আরও একবার, “আমি আসি স্যার, আপনি ভালো থাকবেন, এটাই আমার একমাত্র প্রার্থনা।” বলিষ্ঠ এক পুলিশ অফিসারের হেঁটে যাওয়ার তৃপ্ত ভঙ্গিমায় মনজুড়ে পড়ে রইল এক অসীম আনন্দবোধে।
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.