বিশেষ প্রবন্ধ
ঈশ্বর চিন্তায় কর্মযোগ… রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ এবং রামানন্দ
পর্ব ২
লেখক : অরুণকুমার রায়
বাস্তবিকই, নব্য ভারতের অগ্রদূত রামমোহনকে স্মরণ করার মুহূর্তে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে
আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণকরি - কেননা, রবীন্দ্রনাথ না হলে হয়তো
রামমোহনের জীবন বা আদর্শগুলি কোনো দিনই এমন ভাবে আমাদের
নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠত না। আরও স্মরণ করি গর্বের সঙ্গে আজ এই
কথা যে এঁরা উভয়েই ছিলেন বাঙ্গালী। আর সেই সময়ে বাঙ্গালীরাই
ছিলেন নব্য ভারতের সৃষ্টির মুলে।
ঈশ্বর চিন্তায় কর্মযোগ : রবীন্দ্রনাথ ( বাং ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮)
ঈশ্বর চিন্তা নিয়ে বিশাল কর্মসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রামমোহনীয়
নব রবীন্দ্রনাথ ....যে মানুষ অখিল নিখিলের সঙ্গে আপনার ঐক্যকে
সমস্ত মর্ম দিয়ে উপলব্ধি করেছে - নিখিলের হাহাকার তার চিত্তকে
বিচলিত করে তুলবে । আর মানুষের দুঃখ বেদনায় যাঁর চিত্ত
মুহুর্মুহু তাঁকে বিচলিত করে তুলছে সে কল্পনা নিয়ে ডুবে থাকতে
পারে না। রোম যখন জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে চলেছে, সম্রাট নিরোর
মতন হৃদয়হীনরাই পারে বাঁশি বাজাতে। যার কাছে হৃদয় আছে
সে বাঁশি নয় হাতে বালতি নিয়ে কর্মসাগরে ঝাঁপ দিতে হবে।
“ সর্বত্র শত-শত মানুষের সঙ্গে কবি ঐক্যের উপলব্ধি কবির অন্তরে
যখন অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে উঠল - তখন পদ্মার চরে চরে চখা –
চখীর কাকলী – কল্লোলের মধ্যে স্বপ্ন নিয়ে ডুবে থাকা তাঁর পক্ষে আর
সম্ভব হ'ল না। তূর্য বাজিয়ে তাঁকে ডাক দিল কর্মের মধ্যে ঝাঁপিয়ে
পড়ার জন্য। কবির কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো...
কী গাহিবে,কী শুনাবে! বলো, মিথ্যা আপনার সুখ,
মিথ্যা আপনার দুঃখ। স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ
বৃহৎ জগৎ হতে সে কখনো শেখে নি বাঁচিতে।
মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা।
মৃত্যুরে করি না শঙ্কা। দুর্দিনের অশ্রুজলধারা
মস্তকে পড়িবে ঝরি-- তারি মাঝে যাব অভিসারে
তার কাছে, জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি
যারে জন্ম জন্ম ধরি। কে সে? জানি না কে!
চিনি নাই তারে-- শুধু এইটুকু জানি—
তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তর প্রদীপখানি।...,
কবির ভাবনার ভুবন এতদিন ফুল, তারা, নদী,আকাশ কিন্তু
নিপীড়িত মানুষের জগৎ ছিল দূরে...এই ছায়াময় নদী স্নেহ
বেষ্টিত মোহনীয় বাংলাদেশের এক কিনারে। ছিন্নপত্রের পাতায়
পাতায় কবির অজ্ঞাতবাসের অপরুপ বাণী কবি লিখেছেন...
" কখনো চলেছে চণ্ডীদাস - বিদ্যাপতির কবিতা পড়া , কখনো
সময়কে অধিকার করেছেন কালীদাস। দুপুরবেলা কাটে গল্প
রচনার মধ্যে । লিখছেন ,' আমার এই সাজাদপুরের দুপুর
বেলা গল্পের দুপুর বেলা।' দিগন্তব্যাপী বালির চর ধু ধূ করছে-
পাশ দিয়ে চলেছে পদ্মা। সেই জনহীনান চরে কবির সান্ধ্য ভ্রমণের
একমাত্র সাক্ষী শুক্ল সন্ধ্যার চাঁদ। দিগন্ত বিস্তৃত পদ্মার জল আকাশ
ভরা সূর্য তারা। বেড়ানো শেষ হলে জালি বোটে শুয়ে চুপচাপ সময়
কাটে। সেই সময়ের কথা কবির লেখায়, ” “ চোখের উপর
আকাশ তারায় একেবারে খচিত হয়ে ওঠে। আমি প্রায় রোজই মনে
করি , এই তারাময় আকাশের নিচে আবার কি কখনো জন্ম গ্রহণ
করবো। আর কি কখনো এমন প্রশান্ত সন্ধ্যা বেলায় এই নিস্তব্ধ
গোরাই নদীটির উপর বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন
নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে জালি বোটের উপর বিছানা পেতে পড়ে থাকতে
পাব। “একটা গড়ানো ঘাট, তাতে কেউ বাসন মাজছে, কেউ
কাপড় কাচছে, আবার কোনো লজ্জাশীলা রমণী ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক
করে ধরে জমিদারকে নিরীক্ষণ করছে। ” “ বাস্তবিক রবীন্দ্র
ভাবনায় প্রকৃতির বিচিত্র রূপ ছিন্নপত্রে প্রকাশিত। গ্রীষ্মের খর রৌদ্র
তাপে উদাস দ্বিপ্রহর, বর্ষার নবকৃষ্ণ মেঘ ও অঝোর বর্ষণ শরতের
স্নিগ্ধ নীলাকাশের বর্ণিমা, হেমন্তের কুহেলি বিলীর প্রহর, শীতের
হিমেল রুক্ষতা, বসন্তের বর্ণিল রঞ্জিমা যেমন তাঁর হৃদয়কে আকুল
করেছে তেমনই ভাবেই মানুষের জন্য জেগে উঠেছে তাঁর অনুভবী
মন। এজন্যই পল্লীর মানুষের জন সমাজ সংস্কার , কৃষি উন্নয়ন,
শিক্ষা প্রসারের কথা তাঁর মনে জেগেছে। পরবর্তীকালে
শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন তারই কর্মরূপ। তাই 'ছিন্নপত্র ' কেবল
চিত্রশালাই নয়, তাঁর কর্মশালাও বটে। পদ্মা নেষ কবির প্রাণ প্রবাহিনী ;
মানব প্রকৃতি ও নিসর্গ প্রকৃতি যেন তার দুই তীর। এপারে সীমাবদ্ধ
মানবের ক্ষুদ্র জীবন, পরপারে বিশ্ব প্রকৃতির বিশাল অসীমতা। এ
ভাবেই ছিন্নপত্র সীমা - অসীম, রূপ - অরূপের দ্বৈতলীলাভূমি, যেখানে
ধরা পড়েছে রবীন্দ্র মানসের মর্ত মাধুরী ও অমর্ত্য মধুরিমা। ”
বিস্তীর্ণ সবুজ দুই পাড়, নদীতে নদীতে জল -আনন্দময় বেড়ানো
জীবন ... ধান ক্ষেত,পাট ক্ষেত, সারি সারি গ্রাম সবই কবির চোখে
ভালো লাগছে। এই সবের মাঝেই কবির সঙ্গ দিচ্ছে সুইস কবি,
দার্শনিক হেনরি ফ্রেডেরিক অ্যামিয়েল এর আত্মবিশ্লেষণ মাস্টারপিস
' জার্নাল ইনটাইম, ' ( 'আ্যমিয়েলস জার্নাল'। পরবর্তীকালে দেখা
গেছে এই বইটি নানা ভাবে রবীন্দ্র মননে প্রভাব রেখে গেছে )
সেই নিঃসঙ্গ জীবনের কথা ছিন্নপত্রের পাতায় ...আমি যেনো সেই
মুমূর্ষু পৃথিবীর একটি মাত্র নাড়ীর মতো আস্তে আস্তে চলছিলুম।
আর সকলে ছিল আর এক পারে,জীবনের পারে, যেখানে ব্রিটিশ
গবর্মেন্ট এবং উনবিংশ শতাব্দী এবং চা এবং চুরোট।
দিন যায় - মাস যায় বছর পেরিয়ে যায়। তার পর এলো
ভিতর থেকে একটা নতুন পথে চলবার প্রবল তাগিদ। এই নতুন
পথ হ'লো নিষ্কাম সেবার ভিতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মিলিত হবার
পথ। চখা চখির কাকলী কল্লোল ডুবে গেলো নিখিলের হাহাকারের
মধ্যে। স্বদেশের সহস্র সহস্র নর কংকালের মধ্যে ছড়িয়ে গেলো
কবির চেতনা। তিনি দেখলেন কর্মের জগৎ থেকে আপনাকে দূরে
রেখে ধ্যানের মধ্যে নির্জ্জনে অনন্তকে উপলব্ধি করবার যে আনন্দ-
সেই আনন্দেরমধ্যে নেই আগেকার সেই তীব্রতা। উপনিষদের মন্ত্র
উচ্চারণ করেন - কিন্তু সে মন্ত্র আগেকার মত আর প্রেরণা দেয় না।
কর্মের ভিতর দিয়ে সকলের সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য একটা ব্যাকুলতা
নিজের মধ্যে কবি অনুভব করলেন।
আমার একলা ঘরের আড়াল ভেঙে
বিশাল ভবে
প্রাণের রথে বাহির হতে
পারব কবে ?
প্রবল প্রেমে সবার মাঝে
ফিরব ধেয়ে সকল কাজে,
হাটের পথে তোমার সাথে
মিলন হবে,
প্রাণের রথে বাহির হতে
পারব কবে ?
এই সব কবিতার মধ্যে মানুষের সঙ্গে মিলনের ভিতর দিয়ে
ঈশ্বরকে উপলব্ধি করবার আকাঙ্খা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
গীতাঞ্জলির ছত্রে ছত্রে। মানুষের থেকে দূরে সরে নির্জনে
নিরালায় ভগবানকে উপলব্ধি করার সকল চেষ্টা যে বৃথা। এই
বিফলতার অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথ লিখছেন তাঁর মানুষের ধর্ম
বইটিতে ... " মানুষের ভিতর দিয়েই যে ভগবানের প্রকাশ –
এই সত্যের উপলব্ধি আমার মনের অবচেতন প্রদেশে দিনে
দিনে গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। মানুষের মধ্যেই
ভগবান – এই ধারণা অবশেষে আমাকে বাধ্য করলো আমার
সাহিত্য জীবনের নির্জ্জনতা থেকে বেরিয়ে এসে কর্ম্মজগতে আমার
কাজের অংশ গ্রহন করতে। অনন্তকে শুধু নিজের মধ্যে ধ্যান ক'রে
আমি আর তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না ; যে সব মন্ত্র আমার নীরব
উপাসনার অঙ্গ ছিল, আমার অজ্ঞাতসারে তারাও আমাকে প্রেরণা
দেবার শক্তি কখন হারিয়ে ফেললে। আমি ভিতরে ভিতরে বুঝতে
পারলাম, আমার আধ্যাত্মিক অত্মোলব্ধির জন্য প্রয়োজন নিষ্কাম
সেবা - ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। " মানুষের
মধ্যেই যে ভগবান এবং দেবতাকে দেখবার চোখ যার অন্ধ হয়ে
যায় নি সে যে মানুষের সেবকেই ভগবানের সেবা বলে গ্রহণ
করবে। রবীন্দ্রনাথ আস্তিক ভাবাপন্ন কবি। আত্মপ্রত্যয় সম্পন্ন কবি।
সর্বক্ষণ ঈশ্বরের কথা,ভগবানের কথা, পরম পিতার কথা,
আনন্দময়ের কথা , সুন্দরের কথা। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে এই
আস্তিক্যবাদই রবীন্দ্রনাথকে মহৎ করেছে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে
গভীর আত্ম প্রত্যয় দিয়েছে। মানুষের সামনে একটি আশার
বাণী উচ্চারণ করার শক্তি ও উত্প্রেরণা দিয়েছে । রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বাস করেন উপনিষদের ঋষির মন্ত্র .....
ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্।
ঈশোপনিষদ্-যে সমস্ত বিশ্ব চরাচরের মাঝে একটি অস্তিত্ব একটি
বিশেষ সত্ত্বার প্রকাশকে উপলব্ধি করেছেন, এই সত্ত্বাকে দেবতা
বলুন , সুন্দর বলুন, স্রষ্টা বলুন, ভিন্ন ভিন্ন নামে বলুন , প্রাণ রূপে
তাকে বলুন, আনন্দময় রূপে বলুন, কিন্তু সেই সত্ত্বা আছে সেই
চৈতন্য সত্ত্বা সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতিকে আচ্ছন্ন করে পরিব্যাপ্ত করে
স্রষ্টা রূপে, পালক রূপে,নিয়ামক রূপে, ভবিষ্যত নির্ধারক রূপে
তিনি আছেন। কিন্তু সেই স্রষ্টা, সেই আনন্দময়, সেই ভগবান
তিনি সৃষ্টির বাইরে নয়....
আমার পথের প্রান্তে আমার দেবালয় নয়,
পথের দুই ধারে আমার ভজনালয়।।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন.এই সৃষ্টির মধ্যে তিনি ওতপ্রোত করে আছেন।
রবীন্দ্রনাথের মানসলোকে উপনিষদের প্রভাব । ভারতীয়তার প্রচণ্ড প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ মানুষকে ভালবেসেছেন। যেখানে নিপীড়িত
মানুষ সবার পিছে, সবার নিচে, সব হারাদের মাঝখানেই তো তিনি
ভগবানের আসন বিস্তীর্ণ করতে চেয়েছিলেন। ভগবান তাদের জন্যই
তো বেশি করে ভাবেন এই কথা তো রবীন্দ্রনাথের কথা…
সব চেয়ে দুর্গম-যে মানুষ আপন অন্তরালে,
তার কোনো পরিণাপ নাই বাহিরের দেশে কালে।
সে অন্তরময় অন্তর মিশালে
তবে তার অন্তরের পরিচয়।
পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার,…,
…তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল--
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তারি 'পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার
ঈশ্বর চিন্তায় কর্মযোগ : রামানন্দ ( ইং ২৯.০৫.১৮৬৫ – ৩০.০৯.১৯৪৩ )
ভোরে উঠে সর্বপ্রথম কাজ উপাসনা আর কলেজের পড়া
তৈয়ারী করা। তাঁর মনে ভগবদ্ভক্তি জনসেবা ও উন্নত চরিত্রের
যে উজ্জ্বল আদর্শ অঙ্কিত ছিল তার থেকে বিন্দু মাত্র চ্যুতিও তাঁর
মনকে পীড়া দিত ..... এলাহাবাদে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়
১৮৬৮ সালের আগে। মধ্যে বেশ কয়েক কাজ বন্ধ থাকে।
রামানন্দ এলাহাবাদে ১৮৯৫ সালে আসার পর এখানের কাজ কর্ম
ফের শুরু হয়। প্রথম দিকে রামানন্দ সমাজে আচার্যের দায়িত্ব
পালন করতেন। রামানন্দ উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে ব্রাহ্ম সমাজের
উপাসনায় ভক্ত মন্ডলীর ভীড় বেড়ে যেতো রামানন্দের মর্মস্পর্শী
উপাসনা ও প্রার্থনা সঙ্গীতে। বছরে দুই বার সমাজে উৎসব হতো।
একবার অগ্রহায়ণ ও মাঘ মাসে। রামানন্দ কলকাতার মাঘোৎসবে
পরিবার নিয়ে উপস্থিত থাকতে ভালোবাসতেন বলে সেখানেই
যেতেন কিন্তু অগ্রহায়ণ মাসে এলাহাবাদেই থাকতেন। এই মাসে
ব্রাহ্ম সমাজে ঘটা করে উৎসব হতো। ব্রাহ্মমন্দির প্রাঙ্গণ গাঁদা
ফুলের মালায় সেজে উঠত । রামানন্দের সেদিনের আচার্যের
ভূমিকায় থেকে তাঁর ভগবদ প্রেম , অযস্বী আধ্যাত্মিক বক্তৃতায়
মুখরিত হয়ে উঠত সমাজ মন্দির প্রাঙ্গণ। ব্রাহ্ম সমাজ উৎসব
ও অনুষ্ঠানে রামানন্দের স্ত্রী মনোরমা দেবীও অনেকেই সঙ্গীত
পরিবেশন করতেন। রামানন্দ নিজেও ভালো সঙ্গীত পরিবেশন
করতেন। ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর গভীর
শ্রদ্ধা কিন্তু তিনি ছিলেন খুবই যুক্তিবাদী ( rational) মানুষ।
এলাহাবাদের মাঘ মেলা ও কুম্ভ মেলার বহু সাধু সন্তের আগমন
হতো। রামানন্দের ছিল ভালো ভালো সাধু- সন্তদের প্রতি
গভীর শ্রদ্ধা। এই সময়ে রামানন্দ সাধু সন্তদের তাঁর বাড়িতে
নিয়ে যেতেন। ছোটো বয়েস থেকেই রামানন্দের বিভিন্ন ঋতুর
পুজো, অর্চনা , উৎসব, যাত্রা কথকতা, কীর্তন , রামায়ন গানের
প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ । যাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে রামানন্দ
যৌবনের সাধনা করলেন সেই ভারতপথিক রামমোহনও তো
ছিলেন ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির একজন ভক্ত। শান্তা দেবী
তার বইতে লিখছেন, ভুতভব্য বর্তমান জ্ঞানকে যুক্ত না করলে
পূর্ণ যোগী হওয়া যায় না। যোগী হইলেই তাঁহার ত্রিকাল দৃষ্টি
খুলিয়া যাইবে। সাধকের সাধনাতেও ঠিক তাই, ত্রিকালের প্রতি
কর্তব্য পূর্ণ করা চাই। রামমোহন যেমন সনাতন, তেমনি আধুনিক,
তেমনি ভবিষ্যতের। তাঁহাদের এক যুগ অন্য যুগ হইতে বিচ্ছিন্ন
নহে। গঙ্গা যমুনা সরস্বতী এই ত্রিধারার যুক্তবেণী হওয়াতেই
প্রয়াগ হইলো মুক্তিতীর্থ। তেমনি ত্রিযুগের যুক্তবেণীর সাধক
রামমোহন ও রামানন্দ মুক্তির দীক্ষা দিতে পারিয়াছেন। ঈশ্বরের
স্বরূপ কী! জিজ্ঞাসু মন খুঁজে বেড়ায় মনের ভিতর ....১৮৮৯
তে রামানন্দ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। সেই কালেই শিবনাথ
শাস্ত্রীর অনুসরণে উপবীত বর্জন করেছেন ঠিকই কিন্তু তার
প্রভাবে রামানন্দ যেন দ্বিগুণ পরিমাণে ব্রাহ্মণত্ব ফিরে পেলেন; তেজ এবং ত্যাগ রামানন্দর দ্বিগুণ হয়ে দেখা দিলো।
বাঁকুড়া জেলা স্কুলের মাস্টার মশাই কেদারনাথ কুলভীর
উপদেশ ও তাঁর সংস্পর্শে রামানন্দ ও তাঁর স্কুলের বন্ধুদের নৈতিক
জীবন গঠন আরও উজ্জ্বল হয়। নানা সাধুজনের কাহিনী ছাত্রদের
তিনি শোনাতেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাধনার কথা এই গুরুর
মুখে শুনে সেই সময়েই মুগ্ধ হন। শিবনাথ শাস্ত্রীর অনুপম চরিত্রের
প্রভাবে তাঁর অন্তরের সমস্ত ঐশ্বর্য উজ্জ্বলতর হয়ে উঠে। ১৮৭৮
সালে শিবনাথ শাস্ত্রী, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী সহ আর কয়েকজন মিলে
সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা বলেন, “এখানে সব
মানুষের সমান অধিকার এবং নিছক খাঁটি সত্যের সম্মান এখানে
সব চেয়ে বেশি। ” এখানে তখন গঠনের যুগ, ত্যাগের যুগ,
সেবার ভক্তির ও প্রেমের যুগ। শিবনাথ শাস্ত্রীর “ প্রাণ ব্রহ্ম পদে
হস্ত কাজে তাঁর , এই ভাবে দিন কাটুক আমার ” এই বাণীতে
যুবকেরা মেতে উঠল। এ ছাড়া স্বাধীনতা ছিল শাস্ত্রী মশাইয়ের
জীবনের মূল মন্ত্র। একমাত্র ঈশ্বর উপাসনা করিবে ;
“ রামানন্দর ধর্মানুগত জীবনের প্রত্যেক কাজই ব্রহ্মে সমর্পিত।
"ব্রহ্মনিষ্ঠো গৃহস্থঃ স্যাৎ, তত্বজ্ঞান পরায়ণঃ
যদ্ যদ্ কর্ম প্রকুবীর্ত তদ্ ব্রহ্মণি সমর্পয়েৎ।”
গৃহস্থ ব্যক্তি ব্রহ্মনিষ্ঠ ও তত্বজ্ঞান পরায়ণ হইবেন। যে কোনো
কর্ম করুন তাহা পরব্রহ্মেতে সমর্পণ করিবেন। ব্রাহ্ম ধর্মের এই
অনুজ্ঞা পালনে অবিচলিত পদে তাঁর জীবন পরিচালিত দেখেছি।
ছোটো বড় সকল কাজেই তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করতে
নিয়ত সজাগ ও প্রয়াসী ছিলেন। এ কোন কোন কর্ম ? তিনি
বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন - শুধু ধর্ম কর্ম পূণ্য কর্ম নামে বিদিত
কর্ম নয়। চাষ বাস সব রকম ব্যবসা বাণিজ্য, কারবার, কারখানার
কাজ , নানান রকম চাকুরি ,ওকালতি ডাক্তারী,কবিরাজী ঝাড়ুদার
ও মেথরের কাজ, ইঞ্জিনিয়ারিং আদির কাজ , সব রকম যান –
বাহন পরিচালকের কাজ - এই সমুদয় কাজ ও বহুবিধ কাজ
তাঁকে সমর্পণ করতে হবে - এই উপলব্ধি করে করতে হবে যে,
“ভবদাজ্ঞয়ৈব হিতায় লোকস্য তব প্রিয়ার্থং সংসার যাত্রা মনুবর্ত্তয়িষ্যে।”
অর্থাৎ তোমার আজ্ঞানুসারে লোকের হিতের নিমিত্তে এবং তোমার
প্রীতির নিমিত্তে সংসার যাত্রা নির্বাহ করিতে প্রবৃত্ত হই।
উপনিষদের এই কথা কেবল বক্তৃতার কথা নয় জীবনের প্রতিটি
ক্ষেত্রে এই বাণী রামানন্দর জীবন ব্যাপী সাধনা লব্ধ অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য।
সেবাশ্রম এবং দাসাশ্রম : ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক রামানন্দ বাংলা
সাময়িক পত্রিকার এক যুগান্তর পুরুষ বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে
জাতির যে সেবা করে গেছেন তাতেই তাঁর নাম বাংলা সাহিত্যে
স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । তার পরেও এই মহান কর্মযোগী আর্ত,
অসহায় মানুষের জন্য, সমাজ পরিত্যক্তা নারী জাতির জন্য বহুবিধ
সেবা কাজ করেছেন; তাঁর অন্যান্য কার্য সময়ের মধ্যেই। এক কথায়
তিনি মানব সেবার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপিত করে গেছেন।
দাসাশ্রম ও দাসী পত্রিকা বয়েসে মাত্র এক বছরের ফারাক। ১৮৯১
সালের বশিরহাট সাব ডিভিশন অন্তর্গত জালালপুর গ্রামে ২৭ জুন
১৮৯১ সালে কয়েকটি উৎসাহী যুবকের প্রচেষ্টায় আর্ত মানুষের জন্য
গড়ে উঠলো 'দাসাশ্রম'। কলকাতার পথের ধারের মরণাপন্ন মানুষদের
নিয়ে এসে তাদের একটি গৃহে আশ্রয় দিতেন। রামানন্দ এই কাজে
সর্বত্ব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কিছুদিন পরেই দাসাশ্রম কমিটি
তৈরি হলে রামানন্দ এই কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। কোনো
রকমে এদিক ওদিক চেয়ে চিন্তে সেবা কার্য চলতে থাকে। এই
সবের মাঝেই দাসাশ্রম মেডিক্যাল হল, ঔষধালয় স্থাপিত হয়ে উঠল।
ড: নীলরতন সরকার মশাই দাসাশ্রম কমেটিতে আসলেন। চিকিত্সক প্রাণকৃষ্ণ আচার্য চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে সেবা
কাজকে ত্বরান্বিত করলেন।
শান্তাদেবী তার বইয়ে এই সম্বন্ধে লিখছেন, “ 'দাসী'র সূচনা পূর্বেই
রামানন্দ মানব সেবাব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন। নিজ জীবিকার ব্যবস্থা
হইবার আগেই জনহিতের নানা কল্পনা ও কাজ তাঁকে দিবারাত্রি
মাতাইয়া রাখিতো। একটি কোনো আশ্রম কিংবা ' কুলি সংরক্ষণী
সভা ' খুলিবার ইচ্ছা ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে নিঃসম্বল অবস্থাতেই তাঁর মনে
ঘুরিতেছিল। কাজে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়া একটু আনন্দের আশায় মন
বালিকা –সান্নিধ্য চাহিত কিন্তু অর্থাভাব যখন তাঁকে আনা সম্ভব
হইত না, তখন ক্লান্ত শরীরে ডায়েরিতে লিখতেন :
“ মনে হল সেবাব্রতের ক্লান্তি ও কষ্ট সহিতে সমর্থ করিবার জন্য
পিতা দাম্পত্য সুখ দিয়াছিলেন। একত্রে থাকার সুখ কল্পনা
করিলাম। অমনি একটি অনাথ নিবাস কিংবা দরিদ্র ছাত্রাবাস খুঁকিবার
ইচ্ছা জন্মিল। ” এবার কলকাতার দাসা শ্রম সমাজে পতিতা নারীদের
উদ্ধারের ভার গ্রহণ করলো।
রামানন্দ নিজের দাসী পত্রিকায় নিয়মিত ‘পতিতা রমণীর
দুর্দশা মোচন’, ‘স্ত্রী জাতির দুঃখ বিমোচন’ এমন কি পতিত পুরুষ
জনেদের বিষয়েও এখানে লিখতেন। তদানিন্তন পরাধীন ভারতে
দেশের কোনো প্রান্তেই তো সুখ নাই। এর মধ্যে বাংলাদেশের
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নিরক্ষরতা, দুর্ভিক্ষ, রোগশোক, অধর্ম,
মাদকতা, পশু পীড়ন; দুঃখের অভাব নেই। কৈশোর অবস্থা থেকেই
রামানন্দের মন যেন করুণার সাগর। দেশের জন্য চিন্তা আর মানব
সেবার জন্য উদ্বেল মন।
রামানন্দের স্কুলের এক বন্ধু জাতিতে ছুতোর ছেলে তাঁরই
পাশে বসতো। রামানন্দ চণ্ডীদাসের দেশের সন্তান। শিশুকাল
থেকেই একটি সহজ সরল বিশ্বাস তার মনে লালিত পালিত হয়ে
এসেছিল যে " সবার উপর মানুষ সত্য , তাহার উপরে নাই।"
ছুতোর ছাত্রবন্ধুটির পিঠ হঠাৎ সুড় সুড় করে ওঠাতে সে
রামানন্দকে বলল, "ওহে আমার পিঠ একটু চুলকিয়ে দাও না।
" রামানন্দ সানন্দে তার পিঠ চুলকাইতে শুরু করতেই মাস্টার
মশাইয়ের ছড়ি তার পিঠে, ‘কী, ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে ছুতোরের
ছেলের পিঠ চুলকোবি’? রামানন্দ তার উপবীত বিসর্জনের মানসিক
প্রস্তুতি বোধহয় এই ঘটনা থেকেই নিয়ে ফেলেছিলেন।
রামানন্দের এলাহাবাদের ১৩ বছরের অবস্থান কাল ( ১৮৯৫
থেকে ১৯০৮ ) বাংলা পত্র পত্রিকার ইতিহাসের এক স্বর্ণিম কাল।
‘প্রবাসী’, ‘মর্ডান রিভিয়ু’ প্রভৃতি পত্রিকার প্রকাশনা। কিন্তু রামানন্দের
সেবা কাজ ! নিজের জীবন বিপন্ন করে দিনের পর দিন ভয়ানক মারণ
ব্যাধি প্লেগের আক্রান্ত রোগীদের জন্য ওকুতো ভয় তিনি ও তাঁর
সহযোগী বন্ধুরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই দিন। পরিবারের চিন্তা
না করেই ...তিনি দিনের পর দিন আর্ত মানুষের জন্য নিরলস
কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বাসা বদল, দুটি
সন্তানের মৃত্যুশোক ,কলেজ থেকে পদত্যাগ, কিছুই তাঁকে দমাতে
পারেনি। মাদকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে তাঁর কলম লখনউ এর
এডভোকেট পত্রিকায়। ব্রিটিশ চমকে উঠেছে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে
সুগন্ধির ফুলের গন্ধ সম তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে সম্পুর্ণ সংযুক্ত
প্রদেশে। রবীন্দ্রনাথ,বলেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ , ক্ষিতিমোহন সেন,শ্রীশ
চন্দ্র ও বামনদাস বসু,হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় ( স্বামী বিজ্ঞানানন্দ )
মতিলাল নেহরু, মদনমোহন মালবিয়,নেপালচন্দ্র রায়, ইন্দুভূষণ রায়,
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, বাবুচিন্তামণি ঘোষ,প্রবাসী ও মর্ডান রিভিয়ু
পত্রিকার মুদ্রক তথা তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শোক ,
দুঃখ, আনন্দকে এক সঙ্গে বহন করে চলেছেন যিনি মনোরমা
দেবী। রামানন্দের যোগ্য জীবন সহচরী মনো। শান্তা , সীতা,
কেদার, অশোক , মুলু তখন ছোট। শান্তা,সীতা সব দেখেছে,
বুঝেছে এবং আগামীর দিনে তাঁদের কলমে স্মৃতিচারণ লেখায়
উঠে এসেছে রামমোহনের আত্মিক সন্তান ও রবীন্দ্রনাথের
অভিন্ন বন্ধু রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জীবন বৃত্তান্তের যাপনকথা
.....এলাহাবাদে ব্রাহ্ম সমাজের বহু সভায় এবং বাড়িতেও
রামানন্দের প্রিয় গান তাঁরই প্রাণবন্ধুর লেখা যা তিনি নিজেও
গাইতেন …
আমায় অনেক দিয়েছ নাথ,
আমার বাসনা তবু পুরিল না
দীনদশা ঘুচিল না
অশ্রুবারি মুছিল না ...। '
শেষ করলাম রাজা রামমোহন রায় কৃত একটি ব্রহ্মসংগীতের কথা
দিয়ে...
ভয় করিলে যাঁরে না থাকে অন্যের ভয়
যাঁহাতে করিলে প্রীতি জগতের প্রিয় হয়….,
সুত্র: প্রবাসী পত্রিকা, রবীন্দ্র রচনাবলী, রবীন্দ্র রত্নাবলী , বিভিন্ন রবীন্দ্র বক্তৃতামালা, সাময়িকী পত্র পত্রিকা, শান্তা দেবী লিখিত বই ।
সমাপ্ত