বিশেষ প্রবন্ধ
ঈশ্বর চিন্তায় কর্মযোগ… রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ এবং রামানন্দ
লেখক : অরুণকুমার রায়
প্রাক্-কথন :
রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।
এঁদের নিয়ে আলোচনা করার হেতু এই তিন মহামানবের জীবনের
মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য । রামমোহনের একেশ্বরবাদ চিন্তনের উদ্ভব তাঁর
বিশাল অতিমানবীয় কর্মের মধ্যেও পরিলক্ষিত। সেই প্রভাবই
রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দের কর্ম জীবনেও। এ ছাড়াও তিনজনের
কর্মের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব উপনিষদ ও ভারতীয়তার…..
রামানন্দ জীবনে বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে রামমোহন। তাঁর
জীবনের আদর্শ ছিলেন রামমোহন। রামমোহন রায়ের প্রতি
শ্রদ্ধাশীল তিনি ভক্তি চিত্তে তথা সুযুক্তির মাধ্যমে সর্বত্র বলেছেন
তা বোধহয় আজকের আধুনিক কালে বেশি লোক বলেনি।
অনেকেই তাঁকে রামমোহনের আত্মিক সন্তান বলতেন। রামমোহন
সম্বন্ধে প্রবাসীতে তিনি লিখছেন , “ তিনি বাঙালিদের,
ভারতীয়গণের এবং সমগ্র মানবজাতির যে সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের
আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া তাহা বাস্তবে পরিণত করিবার নিমিত্ত
অধ্যয়ন,চিন্তা, অর্থব্যয় এবং স্বার্থ ত্যাগ করেছিলেন, সেই আদর্শ
তাঁহার নিজের প্রতিভা ও চিন্তা হইতে প্রসূত। তাঁহার মত
ভগবদ্ভক্তি, মানব প্রীতি, সত্যপ্রিয়তা, সাহস, বুদ্ধিমত্তা, অদম্য
উৎসাহ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের সহিত সেই আদর্শের অনুসরণে সমর্থ
একজন মানুষও এখন ভারতবর্ষে নাই।...,”
১৯৩৫ সালে কলকাতায় হিন্দু মিশন রামমোহন রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা
জ্ঞাপন উদ্দ্যেশ্যে একটি সভার আয়োজন করেন। রামানন্দ সেই
সভার সভাপতি আসন অলংকৃত করেন। সেই সভায় অনেকেই
স্বামীজীর নাম করেন। এই প্রসঙ্গেই রামানন্দ বলেন যে,
'ভগিনী নিবেদিতার একখানি বহিতে আছে, যে স্বামীজী বলিতেন
তিনি রামমোহনের প্রদর্শিত পথের অনুসরণ করেন। তিনি আরো
বলেছেন “ এই বিশ্ববন্ধু ভারতে জাতীয়তার জনক এবং জগতে
বিশ্বজনীন তার কায়মনবাক্যে সমর্থক। বাঙালি শিরোমণির মতো
মহত্ব তাঁহার মতো স্বাধীনতা প্রিয়তা অতি দুর্লভ। কিন্তু যে বাঙালির
রক্ত তাঁহার দেহে প্রবাহিত হইত, আমাদেরও শরীরে সেই বাঙালি
শোণিত প্রবাহিত হইতেছে। তিনি যে বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ুর গুণে গড়িয়া উঠিয়াছিলেন, তাহা এখনও রহিয়াছে ;
আমরা অযোগ্য হইলেও তাঁহারই আধ্যাত্মিক বংশধর। ”
রবীন্দ্রনাথ রামমোহন সম্বন্ধে বলেছেন " জীবিতকালে তাঁর
প্রত্যেক কাজে তাঁকে পদে পদে ঠেকিয়েছি। আজও যদি আমরা
তাঁকে খর্ব করবার জন্য উদ্যত হয়ে আনন্দ পাই , সে-ও
আমাদের বাঙালি চিত্তবৃত্তির আত্মঘাতী বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দেয়। "
ঈশ্বর চিন্তায় কর্মযোগ : রামমোহন ( ইং ২২.০৫.১৭৭২ - ২৭.৯.১৮৩৩ )
সহসা মস্তিষ্ক - পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৮৩৩ খিস্ট্রাব্দের ২৭শে
সেপ্টেম্বর ব্রিষ্টলে দেহত্যাগ করেন। ইংলণ্ডেগামী ভারতীয়দের
পক্ষে ব্রিষ্টল তীর্থক্ষেত্র স্বরূপ। ব্রিষ্টলের আর্ণসভেল সমাধিক্ষেত্রে
তাঁহার একটি স্মৃতি মন্দির স্থাপিত হইয়াছে। তাঁহার প্রকৃত
সমাধিক্ষেত্র ষ্টেপলটন গ্রোভ হাউসে। স্মৃতি ফলকে লিখিত নিম্নে
উদ্ধৃত অংশটুকুর মধ্যে ব্রাহ্মধর্ম্মের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহনের
জীবনী ও কার্যাবলী অতি সুন্দর ভাষায় সংক্ষেপে বর্ণিত আছে –
" ইহার নীচে আজীবন ঈশ্বরের একত্বে বিশ্বাসী এবং বিবেকবান
এক ব্যক্তির দেহাবশেষ সংরক্ষিত হইয়াছে। আন্তরিক ভক্তির সহিত
তিনি তাঁহার সমগ্র জীবন ভগবানের সেবায় নিয়োজিত করিয়া ছিলেন।
সহজাত বিপুল মেধাশক্তির বলে তিনি বহু ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলেন ;
এবং তিনি সে যুগের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম ছিলেন। সামাজিক ,
ধর্ম্মনৈতিক এবং ইহ লৌকিক দিক দিয়া ভারতের উন্নতিকল্পে সতীদাহ
প্রথা এবং পৌত্তলিকতা নিবারণ করিবার জন্য, ভগবানের মহিমা প্রচার
এবং মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য তাঁহার অবিরত চেষ্টার কথা
তাঁহার দেশবাসী সর্ব্বদা কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করিতেছে।
“ দীনবন্ধু সি এফ এন্ড্রুজ তাঁহার ইংরেজি পুস্তক Rise and growth
of the Congress এ বলেছেন যে, রাজা রামমোহন তাঁহার সম-
সাময়িক দিগের অনেক উর্দ্ধে অবস্থিত ছিলেন।প্রাচ্য -পাশ্চাত্যের
পুনর্মিলনের তিনি ছিলেন প্রথম উদ্গাতা। ” ধর্মের দিক দিয়া
রামমোহন ছিলেন একেশ্বরবাদী হিন্দু। তথাপি সকল ধর্মের
সত্যকে তিনি অন্তরের সহিত গ্রহণ করিতেন। তাঁহার মত ছিল
উদার, সর্বজনীন। তিনি বিশ্বাস করিতেন , হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান,
ইহুদী, প্রভৃতির ধর্ম বিশ্বাস সেই সার্বজনীন বিশ্বাসেরই বিভিন্ন
রূপমাত্র। কাউন্ট গবলেট ডি আলভিয়েলা তাহার ইংরেজি পুস্তক
Contemporary Evolution in Religious Thought
এ বলেছেন , “ রামমোহন হিন্দুদের মধ্যে বৈদান্তিক, খ্রীষ্টানদের
মধ্যে খ্রীষ্ট বিশ্বাসী এবং মুসলমান দিগের মধ্যে আল্লা বিশ্বাসী
হইয়া থাকিতে ভালোবাসিতেন। এই উদারতা তাঁহার ধর্মবিশ্বাসের
মতই গভীর ও সত্য ছিল। বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা
ব্রাহ্ম সমাজের দান” অধ্যাপক মনিয়ার উইলিয়ামস বলেন,
“তুলনামূলক ধর্ম বিজ্ঞানের আলোচনায় রাজা রামমোহনই ছিলেন
সর্ব প্রথম প্রকৃত উৎসাহী অনুসন্ধিৎসু। কিন্তু সকল সিদ্ধির উর্দ্ধে
ছিল রাজার অসাধারণ ধর্মাশ্রয়ী ব্যক্তিত্ব । তাঁহার জীবনের মূল
ভিত্তি ছিল ধর্ম। ” রোঁমা রোঁলা বলেন, “প্রাত্যহিক জীবনের ভারসাম্য
রক্ষা করিয়া এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখিয়াই রাজা
অধ্যাত্ম জীবনের সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হইয়া ছিলেন। দৈহিক এবং
মানসিক গঠনে তিনি রাজকীয় ভাবে মন্ডিত ছিলেন। রামমোহন
ছিলেন একাধারে আদর্শবাদী ও কর্মবীর ; বিরাট ব্যক্তিত্বশালী,
তেজস্বী অশ্বের ন্যায় প্রতিভা সম্পন্ন”।
টমসন্ এন্ড গ্যারেট তাঁহাদের ইংরেজি গ্রন্থ Rise and Fulfilment
of British Rules in India লিখেছেন " রাজা রামমোহনকে
দুটি বিদেশী জাতির ( ভারতবাসী ও ব্রিটিশ ) মিলনের ফলে প্রাচ্য ও
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মিলন সংঘটিত হইয়াছিলো। রামমোহনের
জীবনচরিত লেখক কোলেট তাঁহার ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে বলেন,
“ইতিহাসে রামমোহন যেন একটি জীবন্ত সেতু। এই সেতুর উপর
দিয়া ভারতবর্ষ তাঁহার অপরিমেয় অতীত হইতে সম্ভাবনাময়
ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হইতেছে। প্রাচীন জাতিবিচার ও বর্তমান
মানবতাবাদ, কুসংস্কার এবং বিজ্ঞান, স্বেচ্ছাচারিতা ও গণতন্ত্র, অচল
বিধিপ্রথা এবং প্রগতি, বহু দেবদেবীতে বিশ্বাস ও অস্পষ্ট অথচ পবিত্র
সত্য ধর্ম্মানুরাগ ইহাদের পরস্পরের মধ্যবর্তী দুস্তর ব্যবধানের উপরে
রামমোহন ছিলেন খিলানস্বরূপ।”...“ধর্মই তাঁহাকে সকলের সহিত
সংযুক্ত করিয়া ছিল, সেই সঙ্গে সংযতও করিয়াছিল এবং তাঁহার
আন্দোলনের প্রেরণা ও প্রসার সাধন করিয়াছিল।”
“ রামমোহনের জীবন নব্য ভারতের নিকট উৎসাহ ও শিক্ষার
উৎসস্থল এবং আদর্শ স্বরূপ।” ( রামমোহন ও বর্তমান ভারত –
স্বামী জগদ্বীশ্বরান্দ প্রবাসী ১৩৫৫) রামমোহন দশটি ভাষা আয়ত্ত করেন,
তার মধ্যে সংস্কৃত ও আরবীতে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য জন্মায় , আর
চারটিতে - ফারসি, বাংলা,হিন্দী ও ইংরেজিতে তিনি অনর্গল বক্তৃতা
করতে ও লিখতে পারতেন। কেবল যদি পাণ্ডিত্যের দিক থেকে বিচার
করা যায় তাতেও তিনি তদানিন্তন জগতের অন্যতম পণ্ডিত ব্যক্তি
হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সমাজ সংস্কারক হিসাবে রামমোহন
দেশের কি মঙ্গল সাধন করে গেছেন তা সর্ববিদিত তার পুনরুক্তি
এখানে আর করছি না। তবে তাঁর সর্বকাজের মধ্যে সতীদাহ রোধ
করার জন্য তিনি যা করেছেন তাতেও তিনি চিরদিনের জন্য আমাদের
কাছে চিরস্মরণীয় ও চির কৃতজ্ঞতা লাভের যোগ্য।
এ দেশে ইংরেজী শিক্ষা প্রচলনের জন্যে তিনি বহুলাংশে দায়ী,
ইংরেজী শিক্ষা প্রচলনের সমর্থন করার জন্য কেউ কেউ ইদানিং
তাঁর নিন্দা করেছেন। ইংরাজী ভাষার শিক্ষাকে বাহন করা যে খুবই
অন্যায় হয়েছিল এ মত সমর্থন করা চলে না। ইংরাজী শিক্ষাতে যে
কোনো উপকার হয়নি এ কথা ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে না । যে উদ্দ্যেশ্যে
ইংরেজীর প্রচলন হয় তা বহুলাংশে সফল হয়েছে। ইংরেজী
ভারতীয়দের ' এক জাতিত্বের ' জ্ঞান দিয়েছে ; ইংরেজী নবিশেরাই
প্রাদেশিক ভাষাগুলিকে নবজীবন দান করেছেন। রামমোহন,
বঙ্কিমচন্দ্র,হেম,মধু, নবীন, রবীন্দ্রনাথের নাম এ সম্পর্কে ভুলে গেলে
চলবে কী!
রামমোহনের ভিতরে দেখতে পাই একটা অপূর্ব সংযম -- বুদ্ধির
উৎকর্ষ ( intellectualism ) - যা তাঁর পূর্বে ভারতীয় ধর্মসাধনার
ক্ষেত্রে কোনদিন বড় একটা দেখা যায় নি। ধর্মকে তিনি
প্রতিদিনের কার্যকলাপের ভিতরেই টেনে নিয়েছিলেন। মানুষের
নিশ্বাস - প্রশ্বাস যেমন স্বাভাবিক, ঈশ্বরণাভূতিকেও তিনি তেমনই
স্বাভাবিক করে নিয়েছিলেন। এদিক দিয়েও তাঁর উপর ইসলামিক
সাধনার প্রভাব আছে বলে মনে হয়। অন্যপক্ষে, এইদিক দিয়ে হিন্দু
সমাজে ধর্ম সাধনা ব্যাপারে যে তিনি এক সম্পুর্ণ নূতন ধারায় প্রবর্তন
করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং এই ধারাটি দেখতে পাই
সম্পুর্ণরূপে সার্থক হয়েছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ,রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা
গান্ধীর জীবনে। কর্ম্মযোগী বিবেকানন্দের উপরও এই ধারার প্রভাব
যে পড়েছে তা আমরা উপরে আলোচনা করেছি। রামমোহনের শিক্ষা
পুরোপুরি ভাবে ভারত আজও গ্রহণ করতে পারে নি – তার ফলে
যে - ' ভারতের ' স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা আজও ঠিক গড়ে
ওঠে নি। ভারতের সর্ব সাধারণের মধ্যে তাঁর বাণী পৌঁছায় নি ;
তাঁর যুক্তিবাদ আজও যেন সকলের প্রাণে আলোড়ন তুলতে পারে নি।
রামমোহনের জীবনের আদর্শই হয়তো অনাগত ভারতের একমাত্র
আদর্শ এবং তাঁর এই আদর্শ সর্ব দিক দিয়ে পুষ্পিত হয়ে উঠেছিল
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবনে। যে ভাব, যে কল্পনা মুকলিত দেখতে
পাই রামমোহনের মধ্যে , তাই যেন ষড়ৈশ্বর্যে আবির্ভূত হয়েছে
রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে উপাস্য যে বিশ্বভূপের
ইঙ্গিত পাই রামমোহনের ব্রহ্মসঙ্গীত গুলিতে, তিনিই আমাদের
একান্ত আপনার হয়ে ধরা দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য ব্রহ্মসঙ্গীতও ' নৈবদ্য ' প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে, যে
তীব্র জ্ঞান স্পৃহা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দর্শন - বিজ্ঞান - শিল্প সমন্বয়ের
আকাঙ্খায় চঞ্চল করে তুলেছিল রামমোহনকে, তাই -ই যেন রূপ
পরিগ্রহ করেছে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে, ভারতের যে রূপ
দেখেছিলেন মানসনেত্রে রামমোহন, সেই ভারতই রূপায়িত হয়েছে
রবীন্দ্রনাথের অমর গাথা “ভারততীর্থ”য়।
ক্রমশ