নব্বর্ষ সংখ্যা✍
চন্দ্রাবলীর সাধ
লেখক : চণ্ডীচরণ দাস
সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই চন্দ্রাবলী ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল ছ’টা বেজে গেছে৷ ধড়ফড় করে উঠে বসল। চোখেমুখে জল দিয়েই ছুটল রান্নাঘরে৷ তাড়াতাড়ি করে দু’কাপ চা তৈরী করে নিয়ে ঢুকল ছেলের ঘরে৷ দেখল শুভ তখনো চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে, আর উৎপলেন্দু শুয়ে শুয়ে মিটি-মিটি চেয়ে আছে৷ উৎপলেন্দুর কাছে এগিয়ে গিয়ে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে ধরে বলল, “কিছু মনে কোরো না বাবা, একটু দেরী হয়ে গেল৷ এই নাও তোমার বেড-টি৷”
উৎপলেন্দু ঝট করে উঠে বসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলে উঠল, “আপনি কেন এত সকালে উঠে কষ্ট করে চা করতে গেলেন মাসীমা? আমার বেড-টি খাওয়ার অভ্যেস নেই৷”
“আমার কিচ্ছু কষ্ট হয়নি বাবা৷ শুভদের জন্যে তো করতেই হয়, তাই তোমাকেও দিলাম, তুমি খাও৷” বলে অন্য কাপটা টেবিলে রেখে ছেলেকে ঠেলা মারলেন, “ওঠ রে, তোর চা নিয়ে এসেছি৷”
একবার ডেকে না উঠতে আবার ঠেলা দিতেই শুভ্ চেঁচিয়ে উঠল, “কেন ভোরবেলা বিরক্ত কর বলতো? একটু ঘুমোতে দাও না৷” বলে চাদরটা টেনে আরও ভাল করে মাথায় জড়িয়ে শুল৷
“আরে ভোর কোথায়? সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে৷ একটু পরে উঠে সময়মত বেড-টি পাসনি বলে আবার হম্বিতম্বি শুরু করবি৷ নে উঠে পড়৷ এখানে তোর চা রইল৷” বলে চন্দ্রাবলী বেরিয়ে গেল৷
উৎপলেন্দু শুভ্রাংশুর কলেজের বন্ধু, বাড়ী বাগনানে৷ শুভ্রাংশুর আগ্রহে কাল কলেজ থেকে চলে এসেছে বন্ধুর বাড়ী, রাত কাটিয়ে আজ কলকাতায় পূজোর কিছু কেনাকাটা করে বিকেলে বাগনান ফিরে যাবে৷ শুভর বাবা ভোরেই বেরিয়ে গেছে ডিউটিতে, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে৷
একটু বেলা হতেই বাইরে বেরোবে বলে দু’জনে চান করতে গেল৷ চন্দ্রাবলী রান্নাঘরে সকলের জলখাবার তৈরী করছিল৷ হঠাৎ ছেলের চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে গেল৷ “আমার জিনস প্যান্টটা কোথায় রেখেছ, পাচ্ছি না?”
“আলমারিতেই তো ছিল বাবা, দেখ না ভাল করে৷”
“দেখলাম তো, নেই ওখানে৷”
চন্দ্রাবলী আলমারিতে প্যান্টটা খুঁজে না পেয়ে বিছানার পাশে এদিক ওদিক দেখতে লাগল৷
“কী যে কর না তুমি?” বলে মুখ বাঁকিয়ে আলমারি থেকে নামানো কাপড়গুলো তুলতে লাগল৷
উৎপলেন্দু বন্ধুর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল৷ বলে উঠল, “বুড়ো ছেলে, তোর জামাপ্যান্ট এখনো মাকে রাখতে হবে কেন রে? নিজের জিনিস নিজে গুছিয়ে রাখতে পারিস না? মাসীমা, আপনি যান তো, ওটা না পায় অন্য প্যান্ট পরে যাবে৷” বলে চন্দ্রাবলীকে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিল৷
তৈরী হয়ে খাওয়ার টেবিলে এসে বসতে চন্দ্রাবলী দু’জনকে খেতে দিল৷ খাবারের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে শুভ মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠল, “এসব কী বানিয়েছ তুমি? সেই রোজকার লুচি আর আলুর দম৷ উৎপলেন্দু এসেছে, ভাল কিছু বানাতে পারলে না?”
চন্দ্রাবলী আমতা আমতা করে বলল, “ভাবলাম ওর ভাল লাগবে, তাই করলাম৷” তারপর উৎপলেন্দুর দিকে চেয়ে বলল, “একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও বাবা, ওবেলা অন্য কিছু করব৷”
উৎপলেন্দু তটস্থ হয়ে বলল, “না মাসীমা, লুচি-আলুর দম খুব ভাল হয়েছে, আমার খুব প্রিয়৷ ওর কথা বাদ দিন তো৷”
খাওয়ার পরে চায়ের কাপ দেখে শুভ আবার মায়ের উপর বিরক্ত হল, “আলমারি থেকে একটা নতুন কাপ বের করে দিতে পারলে না? সেই পুরনো কাপে চা?”
“কেন, এটা তো ভাল কাপই, ক’দিন আগে কেনা! আচ্ছা আমি পাল্টে দিচ্ছি৷”
উৎপলেন্দু বন্ধুর উপরে রেগে উঠল, “কেন, আমি কি ভিআইপি নাকি যে আমার জন্যে স্পেশাল কাপ-প্লেট দরকার? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷ মাসীমা, একদম অন্য কাপ আনবেন না, আমি এতেই খাব৷” বলে চন্দ্রাবলীর হাত থেকে কাপটা নিয়ে চা খেতে লাগল৷
চন্দ্রাবলী উৎপলেন্দুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল৷
কেনাকাটা করে শুভদের ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল৷ চন্দ্রাবলী রান্নাবান্না করে বসেছিল দু’জনের অপেঙ্ক্ষায়। সে তখনো না খেয়ে বসে আছে শুনে উৎপলেন্দু খুব রাগারাগি করল তার ওপর৷ চন্দ্রাবলী যতই বোঝাতে যায় “ছেলেদের না খাইয়ে মা কখনো খেতে পারে?”, সে বুঝতেই চায় না৷
চন্দ্রাবলী তাড়াতাড়ি করে ভাত বেড়ে দিল৷ ছেলেদের খাওয়ার ধরন দেখে বুঝতে পারল রান্নাটা ওদের ভাল লেগেছে৷ শুভ তো খালি ইলিশ মাছ দিয়েই ভাত খেতে লাগল৷ উৎপলেন্দু লক্ষ্য করল মাসীমা প্রায় সব মাছগুলোই তাদেরকে দিয়ে দিচ্ছে৷ শেষে আরও একটা টুকরো উৎপলেন্দুকে দিতে যেতেই সে বলে উঠল, “সব যদি আমাদেরকেই দিয়ে দেবেন তো আপনি ভাত খাবেন কী দিয়ে? মেসোমশায় এসে খাবেন কী? আর লাগবে না আমার৷” বলে হাত দিয়ে আড়াল করে চন্দ্রাবলীকে আটকাল৷
শুভ বলে উঠল, “আরে দিচ্ছে নে না, হাতঘেরা দিস কেন? তুই কি আর এখানে সবদিন আসছিস নাকি?”
“একদম না৷ সব আমরা খেয়ে নেব, আর মাসীমাদের জন্যে থাকবে না, এ হতে পারে না৷”
চন্দ্রাবলী উৎপলেন্দুর মুখের দিকে ফালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, মুখে কথা সরল না৷
খেয়েদেয়ে ওরা উঠে গেলে চন্দ্রাবলী খেতে বসল৷ খেয়ে উঠে বাসনপত্র ধুয়ে শোবার ঘরে এসে একটু বসেছে কি দেখল উৎপলেন্দু ঘরে ঢুকছে, হাতে একটা প্যাকেট৷ চন্দ্রাবলীর হাতে প্যাকেটটা দিয়ে বলল, “মাসীমা, এটা আপনার জন্যে৷”
চন্দ্রাবলী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী আছে এতে?”
“একটা সামান্য কাপড় আছে, পরে একদিন ঠাকুর দেখতে যাবেন৷”
“সে কি, আমার জন্যে আবার কাপড় কিনতে গেলে কেন? বেকার পয়সা খরচ?”
“ঘরের সবাইয়ের জন্যে নতুন জামাকাপড় নিয়েছি, আর আপনার জন্যে নেব না? আপনি যেমন শুভর মা, তেমনি আমারও মা৷ আমার এক মায়ের জন্যে নতুন কাপড় নেব, আর এক মায়ের জন্যে নেব না, তাই কখনো হয়?”
শুভ উৎপলেন্দুর পিছন পিছন এসে সব দেখছিল৷ বলল, “দেখ না মা, কত মানা করলাম, ও কিছুতেই শুনল না৷ তোমার জন্যেও কাপড় নিয়ে এসেছে৷”
চন্দ্রাবলী বিহ্বল হয়ে তাকিয়েছিল উৎপলেন্দুর মুখের দিকে, কী বলবে ভেবে পেল না৷
“আমি তাহলে আসি মাসীমা” বলে উৎপলেন্দু প্রণাম করতে পায়ে হাত দিতে সম্বিৎ ফিরল৷ তার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে ছলছল চোখে বলল, “একবার তোমার মাকে নিয়ে আসবে বাবা? এমন সোনার টুকরো ছেলেকে যিনি পেটে ধরেছেন, এমন শিক্ষা দিয়েছেন, তাকে একবার দেখতে বড় সাধ হয়৷”
“ঠিক আছে, নিয়ে আসব একদিন৷ আপনাকেও কিন্তু আমাদের গ্রামের কুঁড়েঘরে একদিন যেতে হবে মাসীমা, না বললে শুনব না৷”
উৎপলেন্দু বেরিয়ে গেল৷ “আচ্ছা বাবা, তাই হবে” বলে চন্দ্রাবলী ছলছল চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল যতক্ষণ দৃষ্টি যায় উৎপলেন্দুর দিকে৷ মনে মনে বলতে লাগল—ভগবান, পরের জন্মে একে যেন আমার কোলে পাই৷
***