নববর্ষ সংখ্যা✍
যাদবপুরের মোড়ে
লেখক : দেবশ্রী ভট্টাচার্য
রাত হয়ে আসছে, প্রায় দশটা বাজে, একঘণ্টার ওপর হয়ে গেল গাড়ি এখনো যাদবপুরের মোড়ে আটকে আছে। নতুন কেনা আই টেনের এসির কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়াও যেন আর দিগন্তর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন চারদিকের পরিবেশ তার চার বছরের জ্বরে ঝিমিয়ে পড়া ছেলের হাতের তালুর মতো গরম।
- এসিটা একটু কমিয়ে দাও না! ছেলেটার এত জ্বর !
পিছনের সিটে ছোট্ট কম্বলের মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রোহণকে নিয়ে বসে আছে রনিতা! সকাল থেকে বেশ হাসিখুশি ছিল ছেলে। স্কুলে গিয়েছিল, সব ক্লাস ওয়ার্কও করেছে। বিকেলে খেলতে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল। তখনই রনিতা কপালে হাত দিয়ে দেখল , কপাল পুড়ে যাচ্ছে। বাড়িতে যা ওষুধ পত্র ছিল সব ট্রাই করা হয়ে গেছে। কিন্তু জ্বর যে কমছে না ! পাড়াতে যে ডক্টর বসেন, তাঁর চেম্বার বন্ধ। ওদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়নকে ফোন করেও পাওয়া গেল না। কাশ্মীরে বেড়াতে গেছেন। এদিকে ছেলের জ্বর ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। অগত্যা এখন কাছাকাছি কোনো নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
- এসি কমালে গাড়িতে আর বসতে পারবে না! এখন দিনকাল পাল্টে গেছে, এত কম্বল মুড়ি দিয়ে রেখো না , একটু হাওয়া বাতাস লাগাও। এসব ভাইরাল ফিভার,এসিতে থাকলে বরং ভাল , বাইরের ধুলোবালি কম লাগবে।
বিরক্ত হয়ে যায় রনিতা, আই টির ঠাণ্ডা ঘরে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা লোক যখন গড়গড় করে ডাক্তারির জ্ঞান আওড়ায় তখন তো বিরক্তি লাগেই !
- প্লিজ একটু চুপ করবে!
ঝাঁঝিয়ে ওঠে রনিতা। ছেলেটাকে আরো বুকের কাছে চেপে ধরে বলে ওঠে
- গাড়িটা চালাচ্ছ ! সেটাই চালাও না!
একসাথে অনেক খারাপ কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু না ছোটবেলা থেকে বিপদের সময় নিজের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে শিখেছে দিগন্ত। যতটা সম্ভব সুর নরম করেই বলে - কোথায় গাড়িটা চালাব একটু বলে দাও না প্লিজ , দেখছ তো এক ঘণ্টা ধরে সব গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
দিগন্তর কথায় কোনো লাভ হয় না! রনিতা আরো রেগে যায় ,- তোমাকে তো বললাম তখন গুগল ম্যাপে এই রাস্তাটা রেড দেখাচ্ছিল। কেন এলে এদিক দিয়ে !ওই পাশের গলি দিয়ে গেলে তো খানিকটা এগিয়ে যেতাম নাকি !
- চুপ করতো তুমি ! কাজ নেই কম্ম নেই , খালি পিছনের সিটে বসে ব্যাক ব্যাক করে যাচ্ছে, ডিসগাস্টিং।
আর কতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখবে দিগন্ত!
- কলকাতায় জন্মাল, বড় হল, অথচ এখনো কলকাতার রাস্তাঘাট চেনে না। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে আমাকে! ভুলে যেও না, এই যাদবপুরেই বড় হয়েছি আমি। এই গলি আর ওই গলি , যাদবপুরের মোড়টা তো পেরোতে হবে নাকি!
রনিতা চুপ করে যায়, ভীষণ অভিমান হয় তার! দিগন্ত তো জানে রনিতা একটু বেশিই টেনশন করে। দুবার মিস ক্যারেজের পর রোহণ , তাই বোধহয় আরো একটু বেশিই ভাবে ওকে নিয়ে ! একবারের বেশী দুবার হাঁচলেই ঘাবড়ে যায় সে। খেতে গিয়ে ঢেঁকুর তুললেই অ্যাসিডিটির ওষুধ খাইয়ে দেয়। দিগন্ত এরকম চেঁচিয়ে উঠলে রনিতা সাধারণত চুপ করে যায় কিন্তু আজ যেন আর থাকতে পারল না। বড্ড অভিমানে বলে উঠল
- তুমি কী গো ! তোমার একটু কষ্ট হচ্ছে না! আজ সকাল অব্ধি যে ছেলেটা তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছিল, সে এখন কথাই বলছে না, কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ে আছে। বিকেলের পর থেকে কিচ্ছু খায়নি। একটু জল ও খাওয়াতে পারছি না। তোমার একটুও টেনশন হচ্ছে না তাই না!
দিগন্ত চুপ করে রইল। এখন কিছু বলতে গেলেই বড় বড় ডায়লগ দেবে - সারা পৃথিবী রোহণকে যতটা চেনে, রনিতা তার চেয়ে ন মাস বেশী চেনে! বাবাদের চিন্তা, টেনশন আর কে কবে বুঝেছে। অফিস থেকে আসার সময় হলেই ছেলেটা পর্দার কোণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। দিগন্ত বেল বাজালেই দৌড়ে এসে দরজা খুলে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলে
- কিছু এনেছো !
দিগন্তও কম দুষ্টু নয়, হাতের ব্যাগটা পিছনে লুকিয়ে বলে, - কী আনব রোজ রোজ ! কিচ্ছু নেই যা ভাগ !
অদ্ভুত এক অবিশ্বাসের হাসি হেসে পিছন পিছন ঘুরতে থাকে রোহণ।
- কিছু তো এনেছ !
বেশী কিছু নয়, এই ট্রাফিক জ্যামে দাঁড়িয়ে কেনা কমলা রঙের টক মিষ্টি লজেন্সগুলো হাতে পেলেই খুশি ছেলে। আজ অফিস থেকে ফিরতে যখন রোহণের বদলে রনিতা দরজা খুলে দিল, তখনই বুঝেছে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।
দিগন্তর একদম পাশের জানলায় কে যেন বাড়ি মারল, চমকে উঠল দিগন্ত। ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিল। দেখল একটা চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলে হাতে সার বাঁধা লজেন্সের প্যাকেটের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত রাত হয়ে গেল, তাও এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে ছেলেটা ! কে জানে আজ হয়ত ভাল বিক্রি হয়নি ! দিগন্ত পিছন ফিরে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল
- কীরে খাবি নাকি একটা ?
অসুস্থ ছেলের মুখে একটা হাল্কা হাসির রেখা দেখা দিল।
রনিতা ওদিক থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠল - না একদম না! একে জ্বর তার মধ্যে ওইসব লজেন্স একদম না!
দিগন্ত অবাক হয়ে বলল - কেন জ্বরের মধ্যে লজেন্স খেলে কী হবে? এই তো বললে বিকেল থেকে কিছু খায়নি। জলও খাচ্ছে না। লজেন্স খেলে একটু জল তো যাবে !
রনিতা আরো রেগে গেল - তোমার কি বুদ্ধি একেবারেই লোপ পেয়েছে? লজেন্স আর খাবার এক হল। বলছি বিকেল থেকে কিছু খায়নি। খালি পেটে লজেন্স খেলে অ্যাসিড হবে না!
দিগন্ত হেসে ফেলে !
- আচ্ছা তুমি সবসময় ওকে তোমার নিজের সাথে গুলিয়ে ফেল কেন বলতো ! ওর তোমার মতো কথায় কথায় অ্যাসিড হবে না!
- না তুমি ওকে লজেন্স খাওয়াবে না ব্যাস !
দিগন্ত আবার চুপ করে গেল। রনিতা এই ‘হবে না ব্যাস’ টাইপের কথা বলে দিলে আর ওর সাথে তর্ক করা যায় না। বাইরে ছেলেটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধ কাঁচের ভেতর থেকে কোনো কথা কানে আসছে না ঠিকই , তবে এটুকু বোঝার ক্ষমতা ওইটুকু ছেলেরও আছে যে গাড়ির ভেতরে এই কুড়ি টাকার লজেন্স কেনা নিয়ে সামনের সিটের সঙ্গে পেছনের সিটের ঝগড়া বেঁধেছে।
দিগন্ত ছেলেটির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে জানলার কাঁচটা নামিয়ে দিল। কার পারফিউমের সুগন্ধি মেশানো এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া বাইরে আসতেই ছেলেটি চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল। যেন এক নিঃশ্বাসে যতটা পারা যায় ওই ঠাণ্ডা হাওয়া নিজের শরীরের মধ্যে আত্মস্থ করল। ছেলেটার কাণ্ড দেখে দিগন্ত হেসে ফেলল - কীরে হাওয়া খেলি !
ছেলেটাও মুচকি হাসল।
- দে এক প্যাকেট !
- আবার তুমি লজেন্স কিনছ? বললাম না যে ছেলেকে তুমি লজেন্স দেবে না!
মায়ের ধমক শুনে রোহণ গুটিয়ে ছিল, আরো গুটিয়ে কম্বলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। লজেন্স বিক্রি করতে আসা ছেলেটার মুখের হাসিও মিলিয়ে গেল। দিগন্ত একবার ওই ছেলেটার দিকে তাকাল, আর একবার নিজের স্ত্রীর দিকে। তারপর একটা অদ্ভুত মুখ করে বলল - তোমার ছেলেকে দিচ্ছি না, আমি খাব।
সেই ছেলেটির মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল । দিগন্ত লজেন্সটা নিয়ে আবার জানলার কাঁচ বন্ধ করে দিল। প্রথমে একটা লজেন্স খুলে নিজে খেল , তারপর আর একটা প্যাকেট ছিঁড়তে ছিঁড়তে ছেলের দিকে তাকাল। রোহণ বাবার হাতের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। দিগন্ত একবার রনিতার দিকে তাকাল। সে একবার ছেলের কপাল দেখছে, আর একবার পিঠ। কপালটা তুলনায় একটু ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে। বেচারি ঠিক মতো বুঝতে পারছে না- জ্বর কি তবে একটু কমছে? দিগন্ত রনিতার দিকে তাকিয়ে রোহণকে ইশারা করল। বাবার এই ইশারা ছেলে বোঝে। রোহণের শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হল। দিগন্ত হাত বাড়িয়ে তার ভেতরে টুপ করে একটা লজেন্স ঢুকিয়ে দিল। রনিতা আঁতকে উঠল যেন।
- কী হল ! সেই তুমি লজেন্সটা দিলে ! আমার কোনো কথা শুনবে না তুমি তাই না! তোমরা সবাই একরকম!
‘ তোমরা সবাই একরকম’ - এই অভিযোগটা রনিতার মনে প্রায় বছর দশেক ধরে দানা বেঁধেছে। ছোট্ট সেই দানাটা অবহেলায় থাকতে থাকতে দিনে দিনে একটা বিশাল টিউমারের আকার নিয়েছে- এটা দিগন্ত বেশ ভালোই বুঝতে পারে।
রনিতা উত্তর কলকাতার মেয়ে। দিগন্তর সাথে আলাপ কলেজে পড়তে পড়তে। সে সময় রনিতা একদম অন্যরকম ছিল। পড়াশুনায় ভাল, অ্যাম্বিসাস। গ্রাফিক ডিজাইনার, পড়তেই পড়তেই প্রচুর ফ্রিল্যান্সের কাজ করত। সেই মেয়েটাই বিয়ে হয়ে দিগন্তর যাদবপুরের বাড়িতে এসে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল। দিগন্তর বাবা কাকার দুটো পরিবার, দিগন্তরা দুই ভাই, কাকার এক ছেলে এক মেয়ে , দিগন্তর এক পিসীমা - মানে ভাই বোন জ্ঞাতি, গুষ্টি মিলিয়ে আজকের যুগের পক্ষে একটা বেশ বড়সড়ই পরিবার। কাজে - কর্মে, পালা পার্বণে সংখ্যাটা এর দ্বিগুণ , চারগুণ হয়ে যায়। রনিতা মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে বলে , তোমাদের কে যে কার ছেলে, কে কার বোন , কে আমরা মাসি শ্বাশুরি , কে যে পিসি শ্বাশুরি - বিয়ের এত বছর পরেও আমার যেন সব গুলিয়ে যায়। বিয়ের প্রথম প্রথম সব ঠিক ছিল। যাদবপুরের বাড়িতে থেকেই একটা ছোট ফার্মে কাজ করত রনিতা। বাড়ি ফিরে পরিবারের সাথে হাসি ঠাট্টা, উইক এন্ডে বেড়ানো। পুজোর সময় বেড়াতে যাওয়া। কোনো অনুষ্ঠান হলে অফিস ছুটি নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠা - সব হচ্ছিল নিজস্ব ছন্দে। কিন্তু প্রথম সমস্যাটা শুরু হল যখন বিয়ের দু বছরের মাথায় রনিতা কন্সিভ করল।
দিগন্ত আর রনিতা দুজনেই আনন্দে মেতে উঠেছিল, একটা নতুন প্রাণ আসতে চলেছে পৃথিবীতে। কিন্তু আনন্দটা বোধহয় একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল। তখন দিগন্তর গাড়ি ছিল না, বাইকের পিছনে বসে ঘোরা , বেড়ানো, সিনেমা দেখা - একটু যেন পারদটা ওপরের দিকে উঠে গিয়েছিল। দিগন্তর মা বয়স্ক অভিজ্ঞ হলেও কোনো কিছুতেই বারণ করেননি। হয়ত ভেবেছেন , ছেলে বউয়ের ব্যাপার - নাক না গলানোই ভালো কিংবা হয়ত ভেবেছেন থাক না কী হয়েছে, এই বয়সে একটু ঘুরবে ফিরবে না তো কী হবে? সত্যি কারণটা জানা নেই। তবে যেদিন মিসক্যারেজ হল , সেদিন থেকেই রনিতার মনে একটা অদ্ভুত ধারণা জন্মাল, দিগন্তর মা যদি একটু সাবধান করে দিতেন , তাহলে এরকমটা হত না। কেন যে এই ধারনাটা রনিতার মনের মধ্যে গেঁড়ে বসে গেল , সেটা আজও বুঝতে পারেনা দিগন্ত। এরপর থেকেই রনিতা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল। দিনকে দিন পুজো , কবচ, তাবিজ , উপোসের ঘটা বাড়তে লাগল। কিন্তু এত কিছুর পরেও আটকানো গেল না, আবার সেই অঘটন, এবার আরো মারাত্মক। যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন ছিল দিগন্তর ভাইঝি মানে দাদার মেয়ের জন্মদিন। রনিতা সারাদিন ধরে টুলের ওপর উঠে উঠে বেলুন দিয়ে ঘর সাজিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী একাজ করতে তাকে কেউ বলেনি। তবে একথা ঠিক একাজ করতে তাকে কেউ আটকায়ও নি। কিন্তু মাঝরাতে যখন আবার অঘটনটা ঘটে, রনিতা একেবারেই ভেঙে পড়ে এবং এবার আর রাখঢাক না, সোজাসুজি আক্রমণ করে দিগন্তর মাকে। তাঁর জন্যই নাকি এই দুর্ঘটনা হয়েছে।
এরপর থেকে রনিতা একদমই পাল্টে যায়। দিগন্তর বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে, কোনো গেট টুগেদারে দেখা যায় না তাকে। বেড়াতে যাওয়ার পোগ্রাম একের পর এক ক্যান্সেল করতে হয় রনিতার জন্য। তার নাকি বেড়াতে ভাল লাগে না। আর তারপর অবশেষে এল রোহণ। এরপর রনিতা আর কাউকে চেনে না। ছেলের জন্য জীবন পর্যন্ত দান করতে পারে সে। ছেলে কী খাবে, কী পরবে - সব ঠিক করে রনিতা। সে ছাড়া নাকি তার ছেলের সম্বন্ধে আর কেউ জানে না! আর অন্য কেউ কিছু বলতে এলে রনিতা ভালো মন্দ কোনো কিছু না ভেবেই উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে। রোহণ যখন দুবছরের দিগন্তর বৌদি তখন বলল - রোহণকে বরং আমাদের পাড়ার টিউলিপ নার্সারি স্কুলেই ভর্তি করে দাও। বনিও তো ওখানেই পড়েছিল, ওরা একদম হায়ার স্কুলের জন্য রেডি করে দাও।
তার ঠিক দিন সাতেক আগে রনিতা নিজেই দিগন্তকে বলেছিল - ভাবছি এবার টিউলিপে গিয়ে একবার কথা বলে আসি। রোহণকে তো আস্তে আস্তে স্কুলের জন্য প্রিপেয়ার করতে হবে।
দিগন্ত অবশ্য হ্যাঁ না কিছুই বলেনি। ততদিনে এটুকু জেনে গেছে, রনিতা দিগন্তকে ছেলের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করলেও শেষ পর্যন্ত যা করার সেটা নিজের চিন্তার ওপর ভরসা রেখেই করবে। আর তার চিন্তাটাও কেমন যেন হঠাৎ পাল্টে পাল্টে যায়। দিন সাতেক আগে যে রনিতা নিজেই টিউলিপে যাবে বলে ভাবছিল সে এখন বৌদির কথা শুনে হঠাৎ ঠিক করল - না দিদিভাই, আমি নিজেই ছেলেকে বাড়িতে পড়াব। এত ছোট ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর কোনো মানেই হয় না। একটা ছেলেকে হায়ার স্কুলের জন্য রেডি করার মতো বিদ্যা আমার জানা আছে। আর মিক্সিং -এর জন্য যদি বল, বাড়িতে এত লোক দুদিন বাদে বাদে এত রিলেটিভ, আমার তো মনে হয় একটু কম মেশামেশি হলেই বরং ভাল ওর পক্ষে।
রনিতা কাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল ঠিক বোঝা গেল না। তবে দিগন্ত কিন্তু সেদিনই বুঝেছিল,রনিতা আস্তে আস্তে তাদের পরিবার থেকে সরে আসতে চাইছে। অনেকদিন ধরে যেটা চাইছিল, সেটাই একদিন সত্যি করে তুলল রনিতা। আরো বছর দুয়েক বাদে রোহণের যখন চার বছর বয়স তখন ভর্তি হল গড়িয়াহাটের দিকে একটা স্কুলে। বাড়ি থেকে আট দশ মিনিটের রাস্তা। কিন্তু এটুকু জার্নিও নাকি রোহণ করতে পারছে না। সেটা অবশ্য মিথ্যে নয়। রনিতা ছেলেকে আতুপুতু করে মানুষ করতে করতে এমন একটা উচ্চতায় চলে গেছে যে এই দশ মিনিটের রাস্তাও ছেলের কাছে অনেক। পুল কারে আসতে যেতে প্রায়ই ছেলে বমি করে। আর অমনি মায়ের মুখ আমসি হয়ে যায়।
- এইটুকুই তো খায় ,সেটাও যদি শরীরে না থাকে , তাহলে আর কী হবে ! দিন দিন ছেলেটা রোগা হয়ে যাচ্ছে।
এইরকম ঘ্যান ঘ্যান চলল কয়েকদিন। তারপর একদিন বলল - চল গড়িয়াহাটের দিকে একটা ফ্ল্যাট কিনি। ওর স্কুলের ঠিক পাশেই একটা নতুন কমপ্লেক্স উঠেছে। আমি দেখে এসেছি।
- তুমি দেখেও এসেছ?
দিগন্ত অবাক হয়ে গিয়েছিল। রনিতা একবার যেন একটু থমকে গেল। বোধহয় , ভাবছিল দিগন্তকে ছাড়া একদম ফ্ল্যাট দেখে আসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। কিন্তু তারপরই যেন কিছুই হয়নি খুব স্বাভাবিক একটা বাপার - এরকম মুখের ভাব করে বলল - হ্যাঁ , দেখেই আসলাম আসলে , ওদের স্কুলের একদম পাশেই ফ্ল্যাটটা হয়েছে। অনেকেই যাচ্ছে। কয়েকজন তো বুকও করে এসেছে। তাই আর কী একটু ফাঁকা টাইম পেয়ে ঘুরে এলাম। চল না, একদিন দুজনে মিলে দেখে আসি।
দিগন্ত হাঁ করে চেয়েছিল রনিতার দিকে। নিজের বাড়ি ছেড়ে একটা ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত রনিতা একা কী করে নিতে পারে।
তারপর সেই রনিতার এক দাওয়াই। দুদিন বাদে ছেলে যখন বমিতে মাখামাখি শার্ট প্যান্ট নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। তখন সে চিৎকার করে বলল
- ওইখানেই ফ্ল্যাট কিনতে হবে ব্যাস , আমি আর কিছু জানিনা। বাড়ির একদম পাশে স্কুল চাই, তাহলে আর পুলকারের প্রয়োজন হবে না। আমি নিজেই ওকে স্কুলে দিয়ে আসতে পারব।
দিগন্ত ভেবেছিল একবার জিজ্ঞাসা করবে।
- তাতে অসুবিধা কোথায় ! দশ মিনিটের তো রাস্তা। এটুকু তো যাতায়াত করে নিজেই ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া যায়। পুলকারের প্রয়োজন কী !
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সে কথা বলতে পারল না দিগন্ত। রনিতা যখন একবার ‘ব্যাস’ বলে দেয় তখন আর কিছু বলা যায় না। অদ্ভুত ব্যাপার দিগন্তর মা সেদিনও রনিতাকে আটকালেন না।
দিগন্ত, রনিতা আর রোহণ চলে এল তাদের নতুন ফ্ল্যাটে। আজীবন বাইরে বাইরে ঘোরা, অফিসে চাকরি করা, নিজের কাজে ডুবে থাকা মেয়েটা এই ছোট্ট দু কামরার ফ্ল্যাট সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায় । আর ওদিকে খোলামেলা ঘর , উঁচু সিলিং দেখে অভ্যস্ত দিগন্তর এই ফ্ল্যাটে দম আটকে যায়। রনিতা দিন দিন আরো খিটখিটে হয়ে যায়, আর দিগন্ত ডুবে যায় কাজের মধ্যে। এখন আর রনিতা অফিসেও যায় না। দু একটা ফ্রিল্যান্সের কাজ করে, সেটাও একান্ত দায় পড়ে। রোহণের খাওয়া, ঘুম্নো হোম ওয়ার্ক, যোগা ক্লাস, সাঁতার, আঁকা, গান, - সব ঠিকমতো শেষ হওয়ার পর খুব সামান্য সময়ে যতটুকু হয় , ঠিক ততটুকুই। রনিতা বদলে গেছে, দিগন্ত বদলে গেছে,ওদের দুজনের জীবনটাও এই ট্রাফিক জ্যামের মতোই একঘেয়ে ক্লান্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাশের সুইফট ডিজায়ারটা থেকে একটা কান ফাটানো হর্ন গাড়ির ভেতরে থাকা দিগন্তকেও যেন নাড়িয়ে দিল।
- আরে কী হল এত জোরে হর্ন বাজাচ্ছে কেন?
এতক্ষণ রনিতাও চুপ করে ঝিমিয়ে বসেছিল। রোহণ কুণ্ডুলি পাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল এক সময়। এরকম হর্নের আওয়াজে বেচারা চমকে সোজা হয়ে বসে গেছে, আর তাতেই ফোঁস করে উঠল রনিতা।
দিগন্তও ঝিমিয়ে হেলান দিয়ে বসেছিল। হর্নের আওয়াজ শুনে জানলাটা খুলল
- কী দাদা খামোখা হর্ন বাজাচ্ছেন কেন?
- কী করব বলুন তো এতক্ষণ ধরে বসে আছি। গাড়িটা এক চাকা নড়ছে না, আমি আর পারছি না। জানি খুব অসভ্যের মতো কাজ হল কিন্তু আমি অপারগ। এখন একটা চিৎকার করে হর্ন বাজানো ছাড়া উপায় নেই। ট্রাফিক পুলিশের টিকিটিও তো চোখে পড়ছে না।
দিগন্ত হেসে ফেলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ছেলের ঘুম ভাঙানোর পরেও যদি সেই লোকের সাথে দিগন্ত কথা বলে তাহলে হয়ত রনিতা লোকজনের সামনেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেবে ! সেই ভয়ে চুপ করে গেল দিগন্ত।
- কী আর করবে, এত বাজে ভাবে একটা অ্যাকসিডেন্ট হল , ওরাই বা কী করবে। দুজন নাকি স্পট ডেড। অ্যাম্বুলেন্স আসবে বডি তুলবে, তবে তো জ্যাম ছাড়বে।
- হ্যাঁ , ওই অ্যাম্বুলেন্সকে জায়গা করে দিতে গিয়েই তো এই শিবের মাথার জটার আকার নিয়েছে জ্যামটা। একটা তো জায়গা ফাঁকা থাকবে নাকি , তাহলে অন্তত কিছুটা জ্যাম হাল্কা করা যায় !
বেশ অনেকদিন পর দিগন্ত কোনো অচেনা লোকের সাথে কথা বলছে এভাবে, ভাল লাগছে। দিগন্ত পিছন ফিরে রনিতার দিকে তাকাল।
- কিছুই কি করা যাবে না! জ্বরটা তো বাড়ছে আবার !
- এক কাজ কর না, একটু জলপট্টি দাও। রোহণের জল তো এনেছ, ওইটাই রুমালে ভিজিয়ে দাও একটু , আরাম পাবে।
রনিতা হাঁ করে চেয়ে থাকে, দিগন্তর দিকে। এর আগে যখন রোহণের জ্বর এসেছে, দিগন্ত বহুবার বলেছে, - একটু গা গরম হলেই ওষুধ খাওয়াও কেন? একটু জলপট্টি দাও না, মা তো দিত।
এই শেষের কথাটা শুনলেই রনিতা আর জলপট্টির ধারকাছ দিয়ে যেত না! বলত
- ধুস ওসব পাড়া গাঁইয়ে ব্যাপার , আদ্যিকালের ধ্যান ধারণা।
আজকে কথাটা আর একবার বলেও থেমে রইল দিগন্ত। কিন্তু আজ আর রনিতা ঝগড়া করল না। রোহণের ওয়াটার বটল থেকে রুমালে একটু জল নিয়ে জলপট্টি দিল।
দিগন্ত জানলার কাঁচটা আর বন্ধ করল না, এসিটা বন্ধ করে দিল। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ এসি চললে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গাড়ির পেট্রোল সব শেষ হয়ে যাবে। গুমোট পেট্রোলের গন্ধে ভরা হাওয়াটা একঝাক অস্বস্তি নিয়ে এলেও কোনো উপায় নেই। পাশের গাড়ি থেকে ভদ্রলোক উঁকি দিয়ে রনিতাকে দেখল এই গরমে ছেলেকে কম্বল মুড়ি দিয়ে জলপট্টি দিচ্ছে। মুখটা গম্ভীর করে বলল
- কী হয়েছে জ্বর নাকি !
দিগন্তর এসব কথা নিয়ে অচেনা লোকের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তবু উপায় নেই, উত্তর তো দিতেই হবে।
- হ্যাঁ ওই আর কী ! বাচ্ছা তো জ্বরজারি লেগেই আছে।
- যা গরম , ঘাম বসে বসেই জ্বর হয়ে যাচ্ছে, আর এখনকার গরমটাও যেন কেমন একটা। গাছের একটা পাটা নড়ছে না দেখুন।
দিগন্তর ইচ্ছে না থাকলেও দেখতে হয় গাছের দিকে সত্যি তো একটা পাতাও নড়ছে না।
- তা এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছেন? ডক্টরের কাছে? এত রাতে ডক্টর পাবেন ?
- উপায় নেই কী করব। বিকেল থেকে খোঁজাখুঁজি হয়েছে, আজই এমন ভাগ্য কাছাকাছি কোনো ডক্টর পেলাম না। দেখি কোনো নার্সিংহোমে নিয়ে গেলে যদি একটা ট্রিটমেন্ট অন্তত চালু হয়।
ভদ্রলোক একটু কী যেন চিন্তা করলেন , তারপর বললেন - একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না।
দিগন্ত মুচকি হেসে বললেন - না না মনে করব কেন, বলুন না!
- এই সামনে ডক্টর কৌশিক দাসের চেম্বার আছে, ওঁর বাড়িও পাশেই। সবেমাত্র ডাক্তারি পাশ করেছে। চাইল্ড স্পেশালিষ্ট। খুব ভাল। এই তো কদিন আগে আমার বোনপোর চিকিৎসা করল। এক ওষুধেই ফিট। নতুন ডাক্তার তো, শুনেছি, রাত বিরেতে সেরকম রোগি এলে বাড়িতেও ট্রিটমেন্ট করে।
দিগন্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল রনিতার দিকে। ভদ্রলোক যার কথা বলছে, সে দিগন্তর খুড়তুতো ভাই। বছর দুয়েক হয়েছে , ডাক্তারি পাশ করে বাড়ির পাশেই চেম্বার করেছে। দিগন্তরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার থেকে একটু দূরে। রাস্তাটা পার করে মিনিট চারেক হেঁটে একটা গলির মধ্যে। কিন্তু রনিতা কি যাবে?
রনিতাও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
- কিন্তু যাব কী করে ? রাস্তায় তো গায়ে গায়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
- ও বৌদি , চিন্তা করবেন না, আপনি গাড়ি থেকে নেমে আমার গাড়িতে চলে আসুন, পিছনের সিটে জায়গা ফাঁকা আছে। তারপর আমার গাড়ির পাশেই তো ডিভাইডার।
দিগন্ত আবার মুচকি হাসল, বেশ বুদ্ধি করেছে তো লোকটা। রনিতা আর কিছু ভাবল না। কম্বলে জড়ানো রোহণকে নিয়ে ওই ভদ্রলোকের গাড়িতে উঠে পড়ল, তারপর ডান দিকের দরজা খুলে ডিভাইডার। তারপর সেখান থেকে নেমে আর একটা গাড়ি। ওই রনিতা এবার রোহণকে নিয়ে হাঁটছে ফুটপাথ ধরে। রনিতার জীবন এখন ওয়ান ওয়ে , তাই ওই রাস্তায় জ্যাম হয় না। দিগন্ত শুধু চার পাঁচ রকম কথা ভাবতে থাকে, জ্যামে আটকে বসে থেকে।
দিগন্ত সেদিকে তাকিয়ে ভাবল রনিতা সত্যি বদলে গেছে,সেদিনের সেই প্রেমিকা এখন মা হয়ে উঠেছে,সন্তানের কথা ভেবে একদিন যে বাড়ি থেকে চলে এসেছিল, আজ সেই বাড়ির দিকে একের পর এক বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। একবারের জন্যও ভাবল না, ওরা কী ভাবতে পারে! কী ভাববে ! স্বার্থপর, সুবিধাবাদী - ভাবুক না, কী যায় আসে তাতে !