নববর্ষ সংখ্যা ✍
সমাজ সংস্কারক স্বামী বিবেকানন্দ
লেখক : পূর্বাশা মণ্ডল
স্বামী বিবেকানন্দের ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, দেশপ্রেমিক ও সমাজ সংস্কারক।তিনি ছিলেন ঋষি, মন্ত্রদ্রষ্টা।পরাধীন, মৃতপ্রায় ভারতবর্ষে স্বামীজী নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন। আমেরিকার ধর্মমহাসম্মেলনে যোগদান করে বিশ্ববাসীর সামনে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে আধ্যাত্মিকতা ভারতের এক মহান সম্পদ।এইভাবে ভারতবাসীর লুপ্ত আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রত্যয় পুনরুদ্ধারে স্বামীজী সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে। তা হল, বর্তমান সমাজে স্বামী বিবেকানন্দ কি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক? এর উত্তর পেতে হলে স্বামীজীর জীবনদর্শনের ওপর আলোকপাত করার প্রয়োজন আছে।
একথা সত্য, স্বামীজী ছিলেন সন্ন্যাসী। কিন্তু তথাকথিত মুক্তি ও মোক্ষলোভী সন্ন্যাসী তিনি ছিলেন না। সন্ন্যাসী বলতে তিনি বুঝতেন- পরের জন্য প্রাণ দিতে, জীবের গগনভেদী ক্রন্দন নিবারন করতে, বিধবার অশ্রু মুছাতে, পুত্রবিয়োগ – বিধুরার প্রাণে শান্তিদান করতে, অজ্ঞ ইতরসাধারণকে জীবন -সংগ্রামের উপযোগী করতে..... সকলের মধ্যে প্রসুপ্ত ব্রহ্ম -সিংহকে জাগরিত করতে জগতে সন্ন্যাসীর জন্ম হয়েছে।
যেকোন সন্ন্যাসীর পক্ষে শাস্ত্রজ্ঞান এক আবশ্যিক গুণ।কিন্তু শাস্ত্র সম্পর্কে স্বামীজীর মতামত কি ছিল?তিনি বলেছিলেন - শাস্ত্র যদি সমস্ত লোককে সকল অবস্থায় সকল সময়ে সাহায্য করিতে না পারে, তবে সে শাস্ত্রের কি প্রয়োজন?
হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি তেজের সঙ্গে বলেছিলেন – ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো বা দর্শনশাস্ত্র শেখানো তাহাকে অপমান করা।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী। কেমন সে তত্ত্ব? বিবেকানন্দের উত্তর ছিল – আমি তত্ত্বজিজ্ঞাসু নই, দার্শনিকও নই, না, না, - আমি সাধুও নই। আমি গরীব – গরীবদের আমি ভালবাসি।
এই তত্ত্বেই নূতনকে আহ্বান করে তিনি বলেছেন – প্রাচীন সংস্কারগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নূতন করে আরম্ভ করব – একেবারে সম্পূর্ণ নূতন, সরল অথচ সবল ...এখন নূতন ভারত, নূতন ঠাকুর, নূতন ধর্ম, নূতন বেদ।
এখানেই স্বামীজীর বিশেষত্ব।এমন উন্নত ও স্বাধীন চিন্তাভাবনা স্বামীজীর পক্ষেই সম্ভব।বর্তমান তো বটেই, এমন সংস্কারমুক্ত চিন্তাভাবনা সর্বযুগেই কাম্য। স্বামীজীর প্রতিটি ধ্যানধারনা যুক্তি বা বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তিনি ছিলেন বুদ্ধিবাদের ওপর শ্রদ্ধাশীল। নিজের সম্বন্ধেও তিনি ভক্তদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন – যা বলি সেসব কথাগুলো বুঝে নিবি, মূর্খের মতো সব কথায় কেবল সায় দিয়ে যাবি না। আমি বললেও বিশ্বাস করবিনি। বুঝে তবে নিবি।
বস্তুত স্বামীজী ছিলেন নব যুগের পথপ্রদর্শক। মানুষের আত্মিক বিকাশের জন্য তিনি সমাজের সকল মানুষকে আহ্বান করেছেন - এস, মানুষ হও। ... তোমরা কি মানুষকে ভালোবাসো? তোমরা কি দেশকে ভালবাসো? তাহলে এস, আমরা ভাল হবার জন্য-উন্নত হবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি।
বর্তমান সমাজ এক গভীর অসুখে ভুগছে। মানুষ তার মূল্যবোধ হারিয়েছে।একইসঙ্গে হারিয়েছে প্রাণের প্রাচূর্য, বিচারবুদ্ধি, হৃদয়ের অনুভব, মনুষ্যত্ব ও মর্যাদাবোধ।স্বার্থপর মানুষ আজ আর অপরের কথা ভাবে না। সকলেই নিজের প্রয়োজনটুকু মেটাতেই ব্যস্ত। সমাজ তাই দ্রুত অশিক্ষা, কুসংস্কার ও দারিদ্র্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। এই অন্ধকারকে দূর করতে গেলে আমাদের সেই স্বামীজীকেই আবার আশ্রয় করতে হবে।স্বামীজীর চিন্তায় যে তত্ত্ব আছে যা শুধু সেই যুগে নয়, বর্তমানকালে আমাদের তথাকথিত আধুনিক সমাজেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
নবযুগের পথপ্রদর্শক স্বামী বিবেকানন্দের একটি অমর বাণী হল - ওঠ, জাগো, আর ঘুমিও না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের নিজেদের ভিতর রয়েছে, একথা বিশ্বাস করো, তা হলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে।
যেদিন আমরা এই বাণীর প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারব ও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব, সেদিনই এই সমাজতা আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে।