দীপাবলি সংখ্যা
মধুরিমা
লেখক : গৌতম মুখোপাধ্যায়
কি পেয়েছিস বল’ তো? এতো দেরি করে রাতে বাড়ি ফিরবি? কাণ্ড-জ্ঞান বলে কিছু নেই? ভয়-ডর তোর নেই বুঝি? দিনকাল খারাপ। যদি কিছু হয়ে যেতো। শেষে থানা-পুলিশ করতে হতো। কত করে বলেছি রাত করে ঘরে ফিরবি না। কে শোনে কার কথা। এরপর আমি আর তোকে যেতেই দেবো না। ভুলে যেও না তুমি মেয়ে। রাত করে বাড়ি ফেরাটা মেয়েদের জন্য নয়’।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল বুবলির মা। বুবলি বুঝে উঠতে পারছে না কেন মা ওর প্রতি এতে। অগ্নিশর্মা। বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। সিনেমা দেখার পর রেস্টুরেন্টে কিছু টুকটাক খাওয়া হয়েছে। দেরি তো হতেই পারে। তার উপর রাস্তায় ট্রাফিক সিগনাল। এসব কথা মায়ের মাথায় কেন আসে না। কই দাদা নাইট শো দেখে গভীর রাতে বাড়ি ফিরলে তো মা কিছু বলে না’ যত অপরাধ কি শুধু ওর? বকাঝকা ওকেই শুনতে হবে? কেন ও মেয়ে বলে? রাগে বুবলি ফেটে পড়ল। রাতের খাবারও খেতে ডায়নিং রুমে এল না। শুয়ে পড়ল।
সকাল হতেই কাজের বউ পদ্ম মাসি এসে ঘরগুলো সাফ করতে লেগে গেল। বুবলির বাবা ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেছে। মা সকালের চা বানাতে রান্নাঘরে গেছে। দাদা তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি।
চা খেতে খেতে পদ্ম মাসি হঠাৎ কি কথা ভেবে হেসে উঠল। বুবলি বুঝে উঠতে পারল না পদ্ম মাসি কেন হঠাৎ হাসল । বাবাকে চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বুবলির মা পদ্ম মাসিকে জিজ্ঞেস করল— “কিরে হাসছিস যে বড়।’ বুবলির বাবা মাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল ‘থাক না। ওর কি কথা মনে পড়ে হাসি পেয়েছে হয়তো। তা’ হাসুক না । তুমি কেন মানা করবে?’
পদ্ম মাসি তখনো নিজের হাসিটা চাপতে পারল না। অবিরাম হেসে চলেছে। আর কাজ করে যাচ্ছে। রান্নার বাসনগুলো কলতলায় ধুয়ে নিচ্ছে।
সহ্য হল না বুবলির মায়ের। আবার ঝংকার দিয়ে উঠল। চা খাওয়া শেষ হয়েছে কি হয় নি মা বলে উঠল— ‘কিরে, এখনো হাসছিস? তোর হলটা কি? মেয়েদের অত হাসি ভালো নয়। মেয়েদের মৃদুভাষিণী হতে হয়। এটা ভুললে চলবে না। লোকেরা বলবেটা কি?’
বুবলির কাছে মায়ের যুক্তিগুলো গ্রহণযোগ্য বলে মনে হল না। স্বর উঁচু করে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে বসল ‘কেন? পদ্ম মাসির অপরাধটা কোথায়? হাসি পেয়েছে, হাসতেও পারবে না? মা, এ তোমার কেমন শাসন? তোমার যখন হাসি পায় তখন তুমি হাসো না বুঝি? যত দোষ কেবল পদ্ম মাসির বেলায়।’
বুবলির যুক্তি মানতে পারল না মা। তেজ দেখিয়ে বলে উঠল—হাসবে না কেন। তাবলে অমনি খিলখিলিয়ে হাসবে। লজ্জা করে না। চাইলে মেপে মেপে হাসবে। তাবলে..
‘যত লজ্জা শুধু মেয়েদের? ঐ যে তোমার আদরের ছেলে এখনো বিছানায় শুয়ে আছে তার’তো কোনো লজ্জা নেই। দিব্যি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। দাদাকে’তো কিছু তুমি বলছো না? যত দোষ পদ্ম মাসির।’ বুবলি যেন মাকে পালটা প্রত্যুত্তর দিল ।
‘খুব কথা শিখেছ দেখছি। মাকে মুখে মুখে কথা বলা হচ্ছে। পড়াশুনো শিখে এই ভদ্রতা জ্ঞান হয়েছে তোমার। বড়দের কি করে কথা বলতে হয় জানো না বুঝি।’ বুবলিকে মা থামিয়ে দিল।
বুবলির বাবা এবার মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এল। ‘আরে কি লাগিয়েছো তোমরা? ছাড়তো এসব।’
ব্যাপারটা সেই সময়ের জন্য মিটে গেল। বুবলি কলেজে যাবে বলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাবা অফিসে যাবে বলে বাথরুমে দৌড় লাগাল। মা রান্নাঘরে রান্না করতে লাগল ।
হঠাৎ কিসের চিৎকারে বুবলি দোতলা থেকে নীচে নেমে এল। এসে দেখে মা সমানে তরস্বরে কথা বলছে। কি ব্যাপার বুঝে ওঠার আগেই বুবলি দেখতে পেল মা পদ্ম মাসিকে খুঁজে যাচ্ছে। ‘কোথায় গেল পদ্ম? কিছুক্ষণ আগেও’ তো এখানে ছিল।’ মা ছটফট করতে করতে পায়চারি শুরু করে দিল।
‘কি হয়েছে মা? কেন চিৎকার করছো?’ বুবলি অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল।
‘আরে, তোর বাবা অফিস যাবে। এদিকে বাথরুম বন্ধ। পদ্ম যায় নি তো’। কথা বলতে বলতে মায়ের পায়চারি জারি রইল।
‘হতেই পারে। পদ্ম মাসি বাথরুমে গিয়ে থাকবে। তাতে হলটা কি।’ বুবলি মাকে শান্ত হতে বলল।
মা শান্ত হল না। বরং তিরিক্ষি মেজাজে বলে বসল, ‘দেখছে তোর বাবা অফিসে যাবে। সেখানেও কিনা বাথরুমে আগে চলে গেল। পরে গেলে হতো না।’
‘এতে অন্যায়টা কিসের হল মা। ওর হয়তো জোরসে টয়লেট পেয়েছে।’ বুবলি মাকে বোঝাতে চেষ্টা করল। কে বোঝে কার কথা। মা উত্তেজিত গলায় বলে উঠল ‘কেন চেপে রাখতে পারল না।’ হেসে উঠল বুবলি। মাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল –‘কেন চাপবে। প্রকৃতির ডাকে সব মানুষকেই সাড়া দিতে হয়। তুমি জানো টয়লেট চেপে রাখা কত খারাপ। রোগ হয়।’
‘না যেতে পারে না। মেয়েদেরকে নিজের যতই অসুবিধে থাক বুঝে শুনে বাথরুমে যেতে হয়। যখন তখন গেলে হয় না। তাতে তোর বাবার অফিস যেতে দেরি হয়ে যেতে পারে। পদ্মর উচিত ছিল তোর বাবাকে আগে ছেড়ে দেওয়া। ও কি করে কোন ফাঁকে টয়লেটে আগে চলে গেল?’ বুবলির মা কিছুতেই বুঝতে চাইল না। উত্তেজিত ভাব কমতে চায় না।
এ যাত্রায় কথা আর না বাড়িয়ে বুবলি রোজকার মতো কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। আজ বুবলি কলেজ ফেরার সময় হঠাৎ বাসের মধ্যে বান্ধবী পিউকে সঙ্গে পেয়ে গেল। দেখামাত্র ওকে বুবলি পাশের সিটে বসিয়ে নিল। নানা কথার মাঝে বাসটা প্রায় মাঝ রাস্তা পেরিয়ে এসেছে। এমন সময় পিউ বুবলিকে বলে বসল— ‘জানিস আজ মনটা ভালো নেই। হোম ওয়ার্ক সকালে করতে পারিনি।’
‘কেন? কি হয়েছে তোর ? এনি প্রবলেম?’ পিউয়ের দিকে বিস্মিত হয়ে তাকাল বুবলি।
‘আর আমাদের চাকরানি ঘরে কাজ করতে আসেনি। মাকে সাহায্য করতে আমাকেই রান্নাঘরে যেতে হয়েছিল। সকালে পড়াশুনো করার একদম সময় হয়নি।’ পিউয়ের গলায় চিন্তার রূপরেখা।
‘কেন? কেন কাজের মাসি আসেনি।’ বুবলি বাসের জানলার দিকে তাকাতে তাকাতে পিউকে প্রশ্ন করল। ‘সকালে নাকি ওর বর ওকে কি জিজ্ঞেস করেছিল। জবাব দিতে একটু দেরি করায় বর ওর গালে সপাটে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। কাজের মাসি তৎক্ষণাৎ মাটিতে পড়ে যায়। লোকেরা এসে দেখে ওর কান দিয়ে রক্ত পড়ছে। পাড়ার লোকেরা তাড়াতাড়ি বউকে হাসপাতাল নিয়ে যায়। মায়ের মুখে শুনলাম ডাক্তার বলেছে কানের শ্রবণ ক্ষমতা চলে যেতে পারে।’কথাগুলো বলে পিউ ডুকরে কেঁদে উঠল। বুবলি ওর হাতে হাত রেখে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
একটু থিতু হতেই পিউ চোখের জল মুছতে মুছতে বুবলিকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসল—‘আচ্ছা বুবলি, তুই বলতো এসব ঘটনা কেন মেয়েদের ক্ষেত্রে হয় ? মেয়েরা দুর্বল বলে? কই ছেলেদেরতো কিছু হয় না? ওরা তো উদ্ধার পেয়ে যায়।’
বুবলি পিউয়ের কথার সঙ্গে যোগ করে— ‘শুধু দুর্বল বলে নয়। এর পেছনে আছে পুরুষতান্ত্রিকতা। যুগ যুগ ধরে এসব চলে আসছে। মেয়েরা প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছে ঘরে বাইরে। মেয়েদের কথা কেউ বলে না। ছেলেদের কিছু হলে হৈ-চৈ পড়ে যেতো। সমাজে মেয়েদের স্থান এখনো অন্ধকারে। মেয়েরা যতই শিক্ষিত হোক না কেন।’
কখন বাস গন্তব্যস্থলে এসে গেছে বুবলি ও তার বান্ধবী পিউ খেয়াল করেনি। ওরা তৎক্ষণাৎ সিট ছেড়ে নীচে নেমে এল। পরস্পরকে গুড বাই করে ঘরের উদ্দেশ্যে ওরা রওনা দিল। বুবলির ফিরতে ফিরতে পিউয়ের কথাগুলো খুব মনে পড়ছিল। মনটা ভারী হয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় লাগছিল।
এক মাস পরে বুবলিদের ঘরে ছোট মামা এলেন। অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। কোথায় যেন থাকেন। বুবলির নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। তবে জায়গাটা কলকাতা শহর থেকে বেশ দূরে। ট্রেনে করে যেতে হয়। ঐ ছোট মামা বুবলি ও ওর দাদাকে খুব স্নেহ করেন। মামাকে দেখে বাবা ও মা ছুটে এল। মা একটু বেশিরকম আনন্দিত। উচ্ছ্বসিত হল মামাকে দেখে। তৎক্ষণাৎ বলে বসল— ‘কি রে ছোট, অনেকদিন পরে এলি’।
‘সবাই ভালো আছে তো?’
‘হ্যাঁ, সবই ঠিক আছে। তোমরা কেমন আছো?’ পাল্টা প্রশ্ন করে বসল ছোটো মামা।
‘আমাদের একরকম চলে যাচ্ছে?’ মায়ের মুখে খুশির ঝলক।
‘একা এলি যে বড়ো।’ শাড়ির ভাঁজ ঠিক করতে করতে মা ছোটো মামাকে চেয়ারে বসতে বলল।
‘তা এবার চাষবাস কেমন হল?’ বাবা ছোট মামার সঙ্গে চেয়ারে বসে প্রশ্ন করল।
‘খারাপ হয়নি এ বছর।’ মামা মাথা নাড়িয়ে বাবার প্রশ্নের জবাব দিল।
ততক্ষণে বুবলির মা ছোটো মামার জন্য চা ও জলখাবার নিয়ে এসেছে— ‘নে রে, চা খেয়েনে।’
‘এতোগুলো মিষ্টি খেতে হবে। অসম্ভব।’ মামা কিছু মিষ্টি প্লেট থেকে তুলে মাকে ফেরত দিল। যদিও মা সেগুলো নিতে চাইছিল না।
‘একদিন এসো না সবাই মিলে। বুবলিরও ভালো লাগবে। গ্রামের পরিবেশ। তোমাদের ছেলেরও মনে ধরবে।’ মামা চায়ে মুখ দিল।
‘ছুটি কোথায়? অফিস করেই দিন কেটে যায়।’ বুবলির বাবা নিজের অসহায়তার কথা প্রকাশ করল। ‘রোববার এসো।’ ছোটো মামা বাবাকে চেপে ধরল।
‘দেখি সামনের রোববার যাবো।’ বাবা আশ্বাস দিল। বাবার প্রতিশ্রুতিতে মা ও বুবলির খুশি লাগল। বুবলির মনে হল বাবা-মা গেলে দাদাকে রাজি করানো কষ্ট হবে না। তাছাড়া এতদিন পরে সুযোগ এসেছে মামার বাড়ি যাওয়ার। কেউ সুযোগ ছাড়ে নাকি। বুবলি মামাকে বলেই দিল— ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সবাই যাবে।’
পরের রোববার ছোট মামার বাড়ি যাওয়া হল। শহর ছেড়ে গ্রামের পরিবেশ বুবলির বরাবর প্রিয়। মামার বাড়ির সামনে ছোটো একটা পুকুরও আছে। বুবলি ও ওর দাদা সেখানে কিছুক্ষণ পর চলে গেল। ওখানে গিয়ে গ্রামের লোকেদের মাছধরা ওরা দেখল। এভাবে কখন সময় গড়িয়ে গেছে ওরা নিজেরাই জানে না। হঠাৎ ওদের ডাক পড়ল খাবারের জন্য।
‘ওরে তোরা আয়। ভাত খাবি না।’ বুবলির ছোট মামা ডাক দিলেন। বুবলি ও ওর দাদা ফিরে এল ঘরে। হাত-পা ধুয়ে ভাত খেতে ওরা বসে পড়ল। সঙ্গে বাবা ও ছোট মামাও খেতে বসলেন।
ছোটো মামিমা ওদের জন্য স্পেশাল আইটেম করেছেন। মামির রান্নার হাত খুব ভালো। মায়ের মুখে বুবলি আগেই শুনেছিল। এবার সত্যি সত্যি খেতে গিয়ে বুবলি বুঝতে পারল।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই দ্বিতীয় ব্যাচে খেতে বসল গ্রামের স্থানীয় দুজন ভদ্রলোক ও তাদের স্ত্রী। সঙ্গে বুবলির মা। ওরা যখন খাচ্ছে তখন হঠাৎ বুবলির চোখে পড়ে গেল মামির শরীরের দিকে। এতক্ষণ মামিকে ভালোভাবে দেখেনি। বুবলি আবিষ্কার করল ছোট মামি গর্ভবতী। বেশি দিন হয়নি। পেট দেখে তাই মনে হচ্ছে।
বুবলি মামির কাছে গিয়ে বলল— ‘কিগো, তুমি বসবে না খেতে?’
‘নারে বুবলি। সবাই খেয়ে নিক। তারপর আমি না হয় একাই বসব।’ মামি বুবলির কথা মানতে চাইল না। ‘কেন? তোমারই তো আগে খাওয়া দরকার।’ বুবলি মামির কথা মেনে নিতে চাইল না।
‘ঠিক আছে, তোর মামি শেষে খাবে। মেয়েদের সবার শেষে খেতে হয়। ছেলেদের দিয়ে মেয়েরা খায়।’ মা বুবলিকে বোঝাবার চেষ্টা করল।
‘অদ্ভুত যুক্তি তোমাদের। একজন গর্ভবতী তো একা নয়। সঙ্গে পেটে আর একজন আছে। তাকে আগে খেতে না দেওয়াটা প্রচণ্ড অন্যায়। মেয়েদের আগে ছেলেরা খাবে কোথায় এসব লেখা আছে?’ বুবলি যুক্তি দিয়ে মাকে বোঝাতে চাইল।
‘গৃহস্থীকে শেষে খেতে হয়।’ বুবলির মা মানতে চাইল না।
‘এটা অন্যায়, চরম অন্যায়।’ বুবলি প্রতিবাদ করে উঠল তীব্র স্বরে।
সেদিনও বুবলির মনটা ভারী হয়ে উঠল। ছোটো মামার গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে কেবলই ছোট মামির মুখ ভাসতে লাগল। বুবলির খালি মনে হল আমরা কোথায় পড়ে আছি। সমাজ মেয়েদেরকে কোথায় রেখে দিয়েছে। বুবলি এসব একদম মানতে পারে না। অসহ্য লাগে।
একদিন সেটা অন্য রোববার হবে হয়তো। কলেজের পড়াগুলো শেষ করে ড্রয়িং রুমে বুবলি সোফায় এসে বসেছে। বাবা টিভিতে কি যেন দেখছিল। বুবলি মামির প্রসঙ্গটা তুলে বাবাকে প্রশ্ন করল—‘বাবা, তুমি এই অন্যায়টা মানো? তুমি বলো, কোথায় বইতে লেখা আছে এসব নিয়ম-কানুন?’
‘আমাদের সমাজটা পাল্টায়নি। মেয়েদেরকে এখনো সমাজ অপাঙক্তেয়ভাবে।’ বাবা বুবলিকে বোঝাতে চাইল।
‘শুনেছি মেয়ে হয়েছিলাম বলে আমার জন্মকালে ঘরে শাঁখ বাজেনি। মা মাকি সোনগ্রাফি পরীক্ষায় জেনে ছিল গর্ভে মেয়ে এসেছে। তখনকার দিনে এই পরীক্ষা নিষিদ্ধ হয়নি। আমাকে মা মারতে চেয়েছিল। ঠিক বলছি তো বাবা।’ বুবলি বাবাকে সরাসরি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল। বাবার মাথা তখন নীচে নেমে গেছে। কি বলবেন মেয়েকে ভেবে পেলেন না। কেননা মেয়ে যা বলছে, মেয়ে যা শুনেছে সবটাই যে সত্যি। বাবা হয়ে অস্বীকার করবে কি করে?
বুবলি কিছুতেই ভাবতে পারছে না মা নিজে মেয়ে হয়ে কি করে মেয়ের মরণ চেয়েছিল? তা হলে কি মেয়েদের এই অবস্থার জন্য মেয়েরাই দায়ী? পুরুষরা নয়?
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। বাবা প্রায় বলতো ঘরের গ্রিলগুলোতে রঙ করার কথা। মা বরং নানা অজুহাত দিয়ে বাবার এই ইচ্ছেকে রুখে দিতো। এই করে অনেক মাস গেল, এল। একদিন বাবা নিজেই মিস্ত্রি নিয়ে চলে এল। একরকম মাকে না জানিয়ে। এবার কিন্তু মা আর বাধা দিল না। হেড মিস্ত্রিকে বাবার সঙ্গে কথা বলতে দেখল বুবলি। বাবা কোথায় কোথায় রঙ হবে, কোন গ্রিলে কি রঙ পড়বে তা হেড মিস্ত্রিকে বোঝাচ্ছিল। পরের দিনই গ্রিলে রঙের কাজ শুরু হয়ে গেল। কিছুদিন যেতেই বুবলি দেখল ওদের দলে দুজন মেয়ে শ্রমিক কাজ করছে। বুবলি-এর আগে কখনো মেয়ে শ্রমিক চাক্ষুষ করেনি। একদিন কলেজ যাবার সময় বুবলি হৈ-চৈ আওয়াজ শুনতে পেল। যখন ও ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেল, দেখল ওই দুই মেয়েছেলে চিৎকার করছে। চিৎকার শুনে বাবাও এসে পৌঁছালো। বুবলি মেয়ে দুটোকে জিজ্ঞেস করল— ‘কি হয়েছে রে? কেন চিৎকার করছিস?’
‘আজ কতদিন হয়ে গেল হেড মিস্ত্রি আমাদের দিনের পয়সা দেয় না।’ বলতে বলতে মেয়ে দুটো ফুঁপিয়ে উঠল। ‘কেন পয়সা দেয় না?’ ক্ষুব্ধ বুবলি আবার প্রশ্ন করল।
‘তা কি করে বলবো। খালি আজ দেবো, কাল দেবো করছে। পয়সা না পেলে খাটবো কেন। আমাদের সংসার চলবে কি করে।’ চোখের জল শাড়ির আঁচলে মোছার চেষ্টা করল মেয়ে দুটো।
বুবলিকে মেয়ে পেয়ে যেন আপনজন মনে হল ওদের। ওরা বলতে লাগল—‘একরকম খাটুনি। একরকম কাজ। অথচ পুরুষ মিস্ত্রিদের যা মজুরি মেলে তা আমরা পাই না। ওদের অর্ধেক পয়সা আমরা পাই।’ আশ্চর্য হয়ে গেল বুবলি। সোজা হেড মিস্ত্রির কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল ‘কেন এই নিয়ম?’
হেড মিস্ত্রি বিনা সঙ্কোচ জবাব দিল— ‘ওরা মেয়ে তাই।’
ততোধিক বিস্মিত হয়ে বুবলি বাবাকে প্রশ্ন করল— ‘এ নিয়ম কারা করেছে? কোথায় লেখা আছে মেয়ে বলে কম মজুরি পাবে? ওদের পরিশ্রমের কি কোনো মূল্য নেই, মর্যাদা নেই? ওদের অপরাধ ওরা মেয়ে বলে?’
বাবার মুখে কোন উত্তর নেই। বাবা ভাবতে লাগল বুবলি তো ঠিকই বলেছে। বাবা হয়ে কি করে না বলে।
বুবলি চরম আঘাতটা পেল আরও সাতমাস পরে। একদিন কলেজ যাবে বলে প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। এমন সময় ওর মোবাইলে কল এল। মুহূর্তে বুবলি কলটা রিসিভ করল। উল্টো দিকে বান্ধবী পিউয়ের গলা শোনা গেল। গলার আওয়াজটা বেশ ভারী।
জানিস শ্রীতমা হাসপাতালে। অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। তুই চলে আয় হসপিটালে। এলে জানতে পারবি। পিউ ফোনটা ছেড়ে দিল।
ভীষণ ঘাবড়ে গেল বুবলি। হাত-পা কাঁপতে লাগল। কি করবে ভেবে পেল না। তাড়াতাড়ি মাকে যাচ্ছি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
বুবলি যখন হসপিটালে এসে পৌঁছাল তখন ওদের নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বড়ো জটলা দেখতে পেল। ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করে কেবিনের নম্বরটা বুবলি নিয়ে নিল। দ্রুত গতিতে বুবলি এগিয়ে যেতে লাগল। দ্রুত পা ফেলছে বুবলি। তবু যেন মনে হচ্ছে পথ শেষ হচ্ছে না। যখন ও কেবিনের কাছাকাছি এল, তখন দেখল কেবিনের সামনে হাপুস নয়নে কাঁদছে পিউ। বুবলিকে দেখে পিউ জড়িয়ে ধরল। ওই অবস্থায় বলতে শুরু করে দিল— ‘শ্রীতমাকে অ্যাসিড ছুড়ে মারা হয়েছে। মুখটা পুড়ে গেছে অনেকখানি। অবস্থা খুবই খারাপ। ডাক্তাররা বলছেন ৪৮ ঘণ্টা না গেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’ এক নিঃশ্বাসে পিউ কথাগুলো বলল।
‘কে ওকে অ্যাসিড মেরেছে।’ বিষণ্ণ বুবলি নীচু স্বরে জিজ্ঞেস করল পিউকে।
‘কে আবার? একটা ছেলে। ওর পাড়াতেই থাকে। অনেকদিন পেছন নিয়েছিল। উত্যক্ত করতো। রাস্তায় পেলে শ্রীতমাকে টিপ্পনী কাটতো। আজ বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসল। শ্রীতমা সোজা না বলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা অ্যাসিড ছুড়ে মারে। ছেলেটা তৈরি হয়ে এসেছিল।’ পিউ আর কথা বলতে পারল না। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।
বুবলির চোখের সামনে শ্রীতমার মুখটা তৎক্ষণাৎ ভেসে উঠল। এই সেই শ্রীতমা। কলেজের সবচেয়ে শান্ত বন্ধু। এতো ভালো মেয়ে বুবলি ওর বন্ধুদের মধ্যে পায়নি। কি না আছে ওর মধ্যে। লেখাপড়া, আঁকা, খেলা-সব কিছুতেই। ওস্তাদ। কবিতাও লিখতে জানে। নানা বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক করতে পারে। দেখতেও খারাপ নয়। সেই শ্রীতমার কিনা এই পরিণতি হল! এমন ঠান্ডা ও গুণের মেয়েটার এই হাল হল?
বুবলি কাঁদতে কাঁদতে আই.সি.ইউ.-এর কাচের জানলা দিয়ে শ্রীতমাকে একবার দেখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করল। বুবলি দেখল শ্রীতমা শুয়ে আছে। মুখটা ঝলসে গেছে। ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। তারপর আর দেখার চেষ্টা করল না বুবলি। হাত পা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ও যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে।
েক েযন একজন পেছন থেকে বুবলিকে ধরল। তাতেই বুবলির হুঁশ এল। কোনোক্রমে একটা ট্যাক্সিতে ওকে েকউ উঠিয়ে দিল। বুবলি বাড়ি ফিরতে লাগল। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা যেন পেছনে হাঁটছে। রাস্তার দৃশ্যাবলী ঝাপসা লাগছে। বুবলির দুচোখে সমানে জল গড়িয়ে পড়ছে। ট্যাক্সি কোথা দিয়ে যাচ্ছে বুবলির সে খেয়াল নেই। কেবলই তার মনে হাজার প্রশ্ন স্রোতের মতো ধেয়ে আসতে লাগল— কি দোষ করেছিল শ্রীতমা? বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে এটাই কি তার অপরাধ? ইচ্ছে করলে ছেলেরা মেয়েদের উপরে সব কিছু করতে পারে। অথচ মেয়েরা পারে না। কেন? আজ যদি শ্রীতমার কিছু হয়ে যায় তার দাম কে দেবে? মেয়েরা কি খেলার পুতুল? যেমন খুশি ব্যবহার করা যাবে? মেয়ে ও ছেলের মধ্যে এই ভেদরেখা কেন?
ছেড়ে দেবে নাকি? কই আমাদের কথাতে তোমরা তো চাকরি ছেড়ে দাও না? যত আত্মত্যাগ শুধু মেয়েরাই করে যাবে নাকি? তোমরা পুরুষরা কিছুই করবে না বউদের কথা ভেবে। ঘরে-বাইরে কেন সব কিছু মেয়েদেরকে সামলাতে হবে? স্বামীদের কথা বউরা সব মেনে নেবে এটা ভুলে যাও। সময় বদলেছে । মেয়েরা আর পড়ে পড়ে মার খাবে না। একের পর এক শাণিত ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়ে গেল মধুরিমা। ঐ ভয়ংকর আগুনের গোলার কাছে সায়ন্তন টিকতে পারল না। চুপচাপ নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
মধুরিমা আর রাতের ডিনার খেতে পারল না। মনটাই বিষিয়ে গেল। না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে খালি ছটফট করতে লাগল। এরকম করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল মধুরিমা নিজেই জানে না।
পরের দিন যে যার মতো স্বাভাবিক। অন্যদিনের মতো সায়ন্তন ও মধুরিমা অফিস যাবে বলে তৈরি হতে লাগল। কাজের বউ কখন এসে গেছে মধুরিমা খেয়াল করেনি। চটপট ঘরের কাজ শেষ করতে চাইল। ঘড়ির কাঁটা দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। ব্রেক ফাস্ট কোনোক্রমে নাকে মুখে দিয়ে মধুরিমা অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ল। সায়ন্তন বের হল একটু পরে।
অফিসে কাজ করতে করতে মধুরিমার মোবাইলটা বেজে উঠল। অন্যমনস্কতায় ফোনটা ধরল সে।
‘কিরে, তুই এখন কোথায়?’ রূপক ফোন করেছে।
‘আমি অফিসে। বল, তোদের খবর কি?’ গতকালের রাতের জমাট বাধা অস্বস্তি যেন হঠাৎই উড়ে গেল।
‘আজ সন্ধেতে আমরা যাচ্ছি তোর বাড়ি। আমরা মানে আমি ও শুভজিৎ। কোনো অসুবিধা নেই তো? থাকলে বলতে পারিস।’ রূপক মধুরিমার অনুমোদন চাইল।
‘না, না। অসুবিধে হবে কেন? চলে আয় তোরা। বরং এলে খুশিই হবো।’ মধুরিমার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস ভেসে উঠল।
কথাশেষ হতেই মধুরিমা মোবাইলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। ফোনটা ছেড়ে দিতেই এক রাশ চিন্তার মেঘ যেন ধেয়ে এল। মধুরিমা ভাবতে লাগল এখন ও কি করবে। ওদের তো আসার জন্য বলে দিলাম। কিন্তু ঘরের বর্তমান আবহাওয়াটা তো ভালো নয়। গত রাতেই ওর এবং সায়ন্তনের সুতীব্র কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। তীব্র বাদানুবাদ হয়েছে। রূপক ও শুভজিৎ এলে সায়ন্তন ওদেরকে কেমন ভাবে নেবে কে জানে। ও যদি ওদেরকে ভালো ভাবে না নেয়। যদি উল্টোপাল্টা কথা বলে দেয়। তাহলে তো মধুরিমার প্রেসটিজ যাবে। তার উপর শুভজিৎ এই প্রথম ওদের ঘরে আসছে। ও কি ভাববে। আসতে বলে মধুরিমা কোনো ভুল করল নাতো?
এসব হাবিজাবি ভাবনা মধুরিমাকে গ্রাস করল। অফিসের কাজে বার বার আন্ডমাইণ্ডফুল হয়ে যাচ্ছিল। যে ফাইলে সই করার কথা নয়, সেই ফাইলে তাড়াহুড়োতে সই করে বসছিল। কখনো মধুরিমার মনে হচ্ছিল, কেন রূপকের ফোনটা ধরতে গেল। না ধরলেই তো পারতো। না ধরলে এত সব চিন্তাগুলো ধেয়ে আসতো না। চোখের সামনে মোবাইলের স্ক্রিনটা তো দেখা গিয়েছিল। রূপকের নামটা দেখামাত্র ছেড়ে দিলেই তো হতো।
ঘরে ফিরতেই মধুরিমা কাজের বউটাকে দিয়ে মিষ্টির দোকান থেকে কিছু মিষ্টি আনিয়ে নিল। ওর আসার ফাঁকে মধুরিমা ঘরটাকে ভালোভাবে গুছিয়ে নিল। শোবার ঘরের বেডশিটটা চেঞ্জ করে দিল। ডাইনিং রুম ও ড্রয়িং রুমটার আদল বদলে দিল। আধ ঘণ্টার মধ্যে ঘরের চেহারার দ্রুত পরিবর্তন এসে গেল। অফিস থেকে আসার পথে রাস্তায় যে একগোছা রজনীগন্ধা কিনেছিল, তা ড্রয়িংরুমে ফুলদানিতে গুঁজে দিল।
এর আরও আধ ঘণ্টা পরে বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠল। মধুরিমার বুকে যেন ঝংকার দিল। হৃৎপিণ্ডের মাঝে কোথায় যেন শব্দধ্বনি হতে লাগল। কি করবে ভেবে পেল না । তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে মধুরিমা মার্বেলের মেঝেতে পড়েই যাচ্ছিল। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিল। দরজাটা খুলে দিল। চোখের সামনে মধুরিমা দেখল রূপক ও শুভজিৎ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। মধুরিমাও হাসি মুখে ওদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় ঘরের ভিতরে ডেকে নিল।
‘খুব সুন্দর ঘর সাজিয়েছিস দেখছি।’ রূপক অবাক হয়ে চারদিক দেখছিল।
‘সত্যি তোকে মানতে হবে। এত সুন্দর রুচিবোধ। কি করে করিস? সময় কোথা থেকে বের করিস?’ শুভজিতের চোখে আরও বিস্ময়, আরও আপ্লুত হবার পালা।
‘ইচ্ছে থাকলেই সময় বার করা যায়। যেসব মেয়ে ঘর-অফিস করছে তারা কি কোনো অংশে কম? ঘারে বাইরে দুটোকেই সামাল দিচ্ছে।’ মধুরিমার চোখে পরিতৃপ্তির অভিব্যক্তি।
‘তারপর বল, কেমন লাগছে তোদের এখানকার দিনগুলো?’ মধুরিমা কথাকে অন্যদিকে নিয়ে গেল। ‘আমাকে যদি জিজ্ঞেস করিস তবে আমার দারুণ কাটছে। বউ-বাচ্ছা নিয়ে খুব আনন্দেই চলে যাচ্ছে।’ রূপকের গলায় সন্তুষ্টির সুর।
‘আর তোর খবর বল?’ এবার শুভজিৎকে রূপকই চেপে ধরল।
‘আমার আর কেমন যাবে। ব্যাচেলারদের লাইফ তো দিশাহীন। মাথামুণ্ডু নেইয়ের মতো চলে। ছন্নছাড়া।’ শুভজিৎ উদাসীনের মতো কথাগুলো বলল।
‘শীঘ্রী বিয়ে করেনে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ মধুরিমা শুভজিতকে আশ্বাস দিল।
‘আর তোর? তোর খবর তো কিছু বললি না? পুরোদস্তুর সংসারী গিন্নি তুই এখন।’ রূপক মধুরিমাকে পালটা প্রশ্ন করে বসল।
‘আমার কথা বাদ দে। কোনো রকমে চলছে।’ মধুরিমা নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করল।
‘কেন? কোনো রকমে কেন? সায়ন্তন কি তোর আইডিয়াল বর হয়নি।’ রূপক যেন মধুরিমাকে চেপে ধরেছে। সব স্বপ্ন কি চরিতার্থতা পায়। মধুরিমা এবার আপ্রাণ ভাবে নিজেকে ঢাকতে চাইল। চাপা দীর্ঘশ্বাসও পড়ল। এর মধ্যে অফিস থেকে সায়ন্তন ঘরে চলে এসেছে। মধুরিমা লক্ষ করেনি। আজ্ঞায় মজে গিয়েছিল। খেয়াল হতেই মধুরিমা রূপক ও শুভজিতের সঙ্গে সায়ন্তনের পরিচয় করিয়ে দিল। স্মিতহেসে সায়ন্তন শুভেচ্ছা বিনিময় করল।
‘ওদের কিছু খেতে দিয়েছো? নাকি শুধুই বাক্যালাপ চলছে।’ সায়ন্তন মধুরিমাকে খাবারের কথা মনে করিয়ে দিল।
ততক্ষণে কাজের বউ চায়ের ট্রে নিয়ে হাজির। মধুরিমা গরম চায়ের প্লেট শুভজিত ও রূপকের হাতে তুলে দিল। সঙ্গে অন্য প্লেটে নোনতা ও মিষ্টির সমাবেশ।
‘এতো মিষ্টি? এতো খেতে পারবো না।’ রূপক চমকে উঠল।
‘খুব পারবি, আড্ডা মারতে মারতে দেখবি সব পেটে চলে গেছে।’’ মধুরিমা জোর করল।
‘শুভজিৎ পারতে পারে। এখনো অবিবাহিত।’ রূপক শুভজিতকে টিপ্পনী কাটল।
‘জানেন দাদা, মধুরিমার সঙ্গে শুভজিতেরই বিয়ে হতো যদি আপনি না চলে আসতেন।’ রূপক এবার হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিল। মধুরিমা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
‘কেন? হল না কেন?’ সায়ন্তন হেসে জিজ্ঞাসা করল।
‘ভবিতব্য। যার কপালে যা ছিল। এসব কি কেউ খণ্ডাতে পারে?’ রূপক দার্শনিকের মতো কথাগুলো উচ্চারণ করল।
‘বাদ দে তো ওসব।’ মধুরিমা অস্বস্তি ঢাকতে কথাকে অন্য দিকে টার্ন করাতে চেষ্টা করল ভীষণভাবে।
এক সময় রূপক ও শুভজিৎ উঠে দাঁড়াল। মধুরিমা ও সায়ন্তনের কাছ থেকে বিদায় নিল। সহাস্যে ওরাও ওদেরকে গুড নাইট করল।
ঐ মুহূর্তে কিছু না বললেও রাতের ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে এবার সায়ন্তন কথাটা তুলল। ‘তা বিয়েটা শুভজিতের সঙ্গে তোমার হল না কেন?’ সায়ন্তন তাকিয়ে আছে মধুরিমার দিকে।
‘হয়নি মানে হয়নি। তার আবার কারণ আছে নাকি?’ মধুরিমা কারণটা জানাল না।
‘হলেই তো ভালো হতো। গুড ম্যাচিং হতো।’ সায়ন্তনের গলায় শ্লেষ ঝরে পড়ছে।
‘সে জন্যই গতকাল রাত করে বাড়ি ফিরেছিলে? শুভজিতের আর্ট এগজিবিশন দেখবে বলে? ’ এক সঙ্গে শুভজিতের সঙ্গে আড্ডা মেরে তুমি তোমার অতীতের প্রেম ঝালিয়ে নিতে। সায়ন্তন এবার সরাসরি মধুরিমাকে আঘাত হানতে চেষ্টা করল।
‘বেশ করেছি। কেন তোমার সন্দেহ হচ্ছে বুঝি? সন্দেহ কেবল তোমরাই করতে জানো। বউরা বুঝি স্বামীদের সন্দেহ করতে জানে না? তোমরা মেয়েদের কি ভেবেছো বলো তো? নারীদের তোমরা অবলা ভাবো তাই না? মানুষের মর্যাদা দিতে জানো না। গার্লফ্রেণ্ড শুধু পুরুষদের থাকতে পারে। মেয়েদের বয়ফ্রেণ্ড থাকতে নেই। তোমাদের পুরুষতন্ত্র যুগ যুগ ধরে এই ভেবে এসেছো। এখানো তাই ভাবছো। কিন্তু দিন বদলেছে। মেয়েরা আর পড়ে পড়ে তোমাদের অত্যাচার হজম করবে না। মেয়েরাও ঘুরে দাঁড়াতে জানে। এ কথাটা কেন তোমরা বারংবার ভুলে যাও।’ মধুরিমা যেন বিস্ফারিত হল প্রচণ্ডভাবে।
খাওয়া সেরে রাতে বিছানায় শুয়ে মধুরিমাই কেবলই সায়ন্তনের কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সত্যি তো, কেন ওর সঙ্গে শুভজিতের বিয়েটা হল না? হলে মধুরিমার জীবনটা আজ অন্য ধারায় বয়ে যেতো। এই পারস্পরিক সন্দেহ, এই পারস্পরিক অনাস্থা থাকতো না। এক সঙ্গে দুটো জীবন এভাবে ভেঙে পড়তো না। নষ্ট হতো না বহু সম্ভাবনার কোরকগুলো। না পারল সায়ন্তন সুখী হতে, না পারল মধুরিমা। এই রকম ভগ্নদশা জীবন নিয়ে কি লাভ? এতো একরকম তিলে তিলে মরা। শরীরে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা। এভাবে ওরা বাঁচবেই বা কেন? এই পারস্পরিক অনাস্থা থেকে মধুরিমা কেন মুক্তি পাবে না? অকারণ চোখের জল ফেলতে হবে কেন? ও মেয়ে বলে কি? এই অন্তর্দাহ নিয়ে ওকে কেন আজীবন বাঁচতে হবে? নারীর জীবন কি জীবন নয়?