সিষ্টেম ভাঙার লড়াই
লেখক : অমিতাভ মাইতি
জীবন সায়াহ্নে রবীন্দ্রনাথ মনোনিবেশ করেছিলেন নৃত্যনাট্য রচনায়। এই নাটকগুলিতে নট-নটীর পরিবর্তে নর্তক-নর্তকীর ভূমিকাই প্রধান ছিল। সঙ্গীত-নৃত্য ও অভিনয়ের যুগলবন্ধী এই নাটকগুলির নাট্য গুণ নষ্ট করেনি। তবে এই ধরনের নাটকের সম্পূর্ণ বিপরীতে হেঁটে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন 'তাসের দেশ' (১৯৩৩) রূপক নৃত্যনাট্য। সমাজের সনাতন প্রথা, শ্রেণিবিভেদ ও অচলায়তন ভাঙতে প্রয়োজন একটি নব শক্তির উত্থান। নতুন জীবনের সন্ধানে মুক্তির বার্তা নিয়ে এগিয়ে চলার কাহিনি রবীন্দ্রনাথের নাটক 'তাসের দেশ'।
তুমি কষে ধরো হাল,
আমি তুলে বাঁধি পাল....।"
(রাগ : ইমন, তাল : কাহারবা, পর্যায় : বিচিত্র, রচনাকাল : ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ/১৯২৭ খৃষ্টাব্দ)
নাটকের শুরুতে এই গানটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিনি ছোটখাট বিপ্লবের জন্য এই নাটক রচনা করেননি। গানটিতে প্রকৃতির যে ঝঞ্ঝাপূর্ণ সময়ের কথা বলা হয়েছে, তাকে যদি ভারতের সেই সময়ের সমাজ ধরে নিই, তাহলে সেই সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ ভুলে সবাইকে একত্রিত হয়ে লড়াই করতে বলেছেন তিনি এবং সে লড়াই অবশ্যই সমাজের সিষ্টেমের মধ্যে থেকে সিষ্টেম ভাঙার লড়াই।
রবীন্দ্রনাথ যে শুধুমাত্র একজন বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক ছিলেন তা নয়, তিনি একজন বিশ্বখ্যাত দার্শনিকও ছিলেন, এ কথা সর্বজন বিহিত। একটা ব্যাপারে আমরা যদি একটু খেয়াল করি তাহলে দেখব যে, রবীন্দ্রনাথ নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে এবং লিখেছিলেন --
"স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক'রে তোমার নামে "তাসের দেশ" নাটিকা উৎসর্গ করলুম।"
আসলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখেছিলেন সেই সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সিষ্টেম ভেঙে নতুন সিষ্টেমে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র দেশবাসীকে একত্রিত করে প্রবল পরাক্রম ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারবেন একমাত্র সুভাষচন্দ্র বসু। তাইতো আমরা নাটকের রাজপুত্রের সঙ্গে নেতাজীর 'সিম্বলিক' মিল খুঁজে পাই।
রাজপ্রাসাদের প্রাচুর্য, সোনার বেড়ির বন্ধন, প্রত্যহ চারণদের স্তব শোনা, যৌবনের একঘেয়েমি রাজপুত্রের আর পোষাচ্ছে না, তাই সে নবীনাকে (এখানে অ্যাবস্ট্রাক্ট) খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছেন --
"গোপন কথাটি রবে না গোপনে,
উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।
না না না, রবে না গোপনে।
বিভল হাসিতে
বাজিল বাঁশিতে,
স্ফুরিল অধরে নিভৃত স্বপনে --
না না না, রবে না গোপনে...।"
(রাগ : কালাংড়া, তাল : কাহারবা, পর্যায় : প্রেম, রচনাকাল : ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ/১৯৩৯ খৃষ্টাব্দ)
আবার সেই সময়ে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষিতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মনে হয়েছিল যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদের পথ সঠিক নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুক্তির আন্দোলন একঘেয়েমি অর্থাৎ ভোঁতা হয়ে গেছে। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য উৎখাত করার জন্য দেশের বাইরে থেকে ইংরেজ বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের বাইরের বিভিন্ন জেলে আটক ভারতীয়দের নিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী তৈরী করে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পরের ঘটনা সকলকেই অবহিত। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি এই যুক্তিটা পুরোপুরি আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ।
এদিকে সোনার খাঁচায় (রাজত্ব) সোনার বেড়ি (রাজ সিংহাসন) পড়ে দানাপানির (ধনসম্পদ) লোভে রাজপুত্র আর রাজপ্রাসাদে বন্দী থাকতে রাজি নয়। সে অজানাকে জানার আগ্রহে, অচেনাকে চেনার আনন্দে উন্মুক্ত আকাশে বসন্তের হাঁসের দলের মতো ডানা মেলতে চায়। তাইতো রাজপুত্র তার বন্ধু সওদাগর পুত্রকে সাথে নিয়ে সাগরে নৌকা ভাসিয়ে দেয় --
যাবই আমি যাবই, ওগো,
বাণিজ্যেতে যাবই।
লক্ষ্মীরে হারাবই যদি
অলক্ষ্মীরে পাবই।"
অকূল দরিয়ায় নৌকা ভাসিয়ে রাজপুত্র গান ধরে --
"নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ
প্রবাল দিয়ে ঘেরা,
শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে
সাগর-বিহঙ্গরা।
নারিকেলের শাখে শাখে
ঝোড়ো হাওয়া কেবল ডাকে,
ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে
বইছে নগনদী --
সাত রাজার ধন মানিক পাবই
সেথায় নামি যদি..."
(রাগ : খাম্বাজ, তাল : দাদরা, পর্যায় : বিচিত্র, রচনাকাল : ১৩০৭ বঙ্গাব্দ/১৯০০ খৃষ্টাব্দ)
রাজপুত্রের কন্ঠে গান শুনে বন্ধু সদাগর পুত্র জানতে চায় -- এ মানিক তো সদাগরি মানিক নয়। তাহলে এ মানিকের নাম?
রাজপুত্র উত্তরে, গানের সুরে বলে ওঠে --
"হে নবীনা, হে নবীনা
প্রতিদিনের পথের ধুলায় যায় না চিনা।
শুনি বাণী ভাসে
বসন্তবাতাসে,
প্রথম জাগরণে দেখি সোনার মেঘে লীনা।"
(রাগ : ভৈরবী-বাউল, তাল : দাদরা, পর্যায় : প্রেম, রচনাকাল : ১৩৪০ বঙ্গাব্দ/১৯৩৪ খৃষ্টাব্দ)
সাগরে ভাসতে ভাসতে অবশেষে তাদের নৌকা এসে ভেড়ে আজব দেশ 'তাসের দেশ'-এ। তাসের দেশে পৌঁছে তারা দেখে, এ দেশের মানুষের চলাফেরা, কথাবার্তা ও আচার-আচরণ সব পুতুলের মতো। তাদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছাস নেই। দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও কাজের প্রক্রিয়াটাও একটা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে। রাজার আদেশেই পরিচালিত হয় সবকিছু --
"এলেম নতুন দেশ
তলায় গেল ভগ্ন তরী, কূলে এলেম ভেসে...।"
(রাগ : বেহাগ-বাউল, তাল : কাহারবা, পর্যায় : প্রেম, রচনাকাল : ১৩৪০ বঙ্গাব্দ/১৯৩৩ খৃষ্টাব্দ)
এদিকে রাজপুত্রের চঞ্চলতা আর চিন্তাধারা প্রবাহিত হয় ইস্কাবনী, রুইতন, হরতনী, চিঁড়েতনী ও তাসের দেশের অন্যান্য নারী-পুরুষদের মধ্যে। তাইতো রাজপুত্রের সঙ্গে তারা গাইল নিয়ম ভাঙার গান --
"আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।
আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।
আমরা বেড়া ভাঙি,
আমরা অশোকবনের রাঙা নেশায় রাঙি,
ঝঞ্ঝার বন্ধন ছিন্ন করে দিই --
আমরা বিদ্যুৎ...।"
( রাগ : খাম্বাজ, তাল : ষষ্ঠী, পর্যায় : বিচিত্র, রচনাকাল : ১৩৪০ বঙ্গাব্দ/১৯৩৩ খৃষ্টাব্দ)
অবচেতনে সবাই মানুষ হয়ে ওঠার বাসনায় যোগ দেয় বিদ্রোহে। একপর্যায়ে রানিও যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। শেষে রাজা জনমতকে মান্যতা দিয়ে তাসের দেশের সব নিয়মকানুন ও অচলায়তন জলে ভাসিয়ে সকলের সাথে গাইলেন মুক্তির গান --
"বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও,
বাঁধ ভেঙে দাও।
বন্দী প্রাণমন হোক উধাও।
শুকনো গাঙে আসুক
জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক --
ভাঙনের জয়গান গাও।
জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক,
যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক।
আমরা শুনেছি ওই
মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ
কোন্ নূতনেরই ডাক।
ভয় করি না অজানারে,
রুদ্ধ তাহারি দ্বারে দুর্দাড় বেগে ধাও।"
(রাগ : ইমন, তাল : কাসারবা, পর্যায় : বিচিত্র, রচনাকাল : ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ/১৯৩৯ খৃষ্টাব্দ)