গল্প ডায়নার রহস্যময় পৃথিবী
পাঁচতলা ফ্ল্যাটের তিন তলার ঝুল বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে কিরণশংকর দেখলেন সুসজ্জিত পোড়ামাটির কারুকার্য দ্বারা নির্মিত গেটে নেভি ব্লু কালারের গাড়ি থেকে হলুদ রংয়ের স্ট্যান্ডার্ড শিল্কের শাড়ি পরিহিতা সুঠাম হরিণ নয়নাভিরাম চেহারার সুন্দরী নামলেন৷ নাম ডায়না, শরীর স্বাস্থ্য সব সময় সুন্দর, হাসি লেগেই থাকে কিন্তু হৃদয় রহস্যের আঁতুড় ঘর৷
সাধারণত বাঙালি এত লম্বা ও সুসামঞ্জস্য গড়নের মহিলা প্রায়ই চোখে পড়ে না৷ ট্রলি ব্যাগ টেনে তুলছে ডায়না, ওর সঙ্গের পুরুষ বা কই? হ্যাঁ--- পুরুষটি বেরোলো৷ কিরণ শংকর সপ্তাহখানেক দাঁড়ি না কামানোর জন্য খোঁচা খোঁচা হয়েছে৷ পাকা চুল উঁকি মারে, মন বিষন্ন, ডায়নাকে বরণ করার জন্য এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শরীর খারাপের জন্য যেতে পারল না৷
ডায়না ওপর দিকে তাকাতেই কিরণশংকর হাত নাড়লো, চিৎকার করে বললেন--- চার তলায় চলে আয়৷
জিনিসপত্র পরস্পরকে তুলতেই হবে! কিরণশংকরের চাকর বাকর নেই, তাছাড়া কিরণশংকর একটু আদুরে ছেলে, ভারী জিনিস দেখলে চেঁচায়৷ সর্বপ্রথম বড় মাপের ব্যাগ নিয়ে উঠে এলো পুরুষটি, কিরণশংকরের সঙ্গে পরিচয় না থাকার জন্য তার দিকে মাথা ঝুঁকে নমস্কার করলেন৷ কিরণশংকর হাত তুলে দেখালেন--- ওই যে ডানদিকের ঘরে সব কিছু রাখুন৷
ডায়নার হাতেও বড় ব্যাগ, চামড়ার ব্যাগ৷ সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে ডায়নার ফর্সা সাজগোজের ফিনফিনে মুখের ঘাম বেরিয়ে গেছে৷ জিনিসপত্র গুলো রেখে দিয়ে সে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো--- উফ! কেমন আছো কিরণদা?
কিরণশংকর বললো--- ডানদিকের ঘরটা তোদের জন্য বরাদ্দ, পছন্দ হয়েছে তো৷ প্রায় আস্ত সংসার তুলে এনেছিস৷
ডায়না বলল--- দুজনের ছোট্ট সংসার!
কিরণ বলল--- কে আর থাকবে?
ডায়না ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না, তাই জিজ্ঞেস করল--- একা একা থাকা ঠিক সুবিধের নয়৷
কিরণশংকর বললেন--- নন্দকুমার এর মতো মফঃস্বল শহরে কাজের লোক পাওয়া মুশকিল অথচ কলকাতায় কাজের মাসি চাইলেই পাওয়া যায়৷ তোদের এখানে সবকিছু নিজেদের করে নিতে হবে মনে হচ্ছে৷ এরপরে পুরুষ মানুষটি কয়েকটি ব্যাগ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির৷ ডায়না পুরুষের কাঁধ থেকে ব্যাগ নামালো৷
কিরণদা এ হচ্ছে হরপ্রসাদ চ্যাটার্জী৷ এখানের সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল হিসাবে জয়েন করতে এসেছেন৷হরপ্রসাদ কিরণদার পুরো নাম--- কিরণশংকর চক্রবর্তী৷ কিরণদা আমাদের পরিবারের মেম্বারের মত, তবে কিরণদার একদমই পরিবর্তন নেই৷ শরীর একটুখানি গোলগাল হয়েছে মাত্র৷
কিরণশংকর বললেন--- সোজা ভিতর গিয়ে ডান পাশে রান্নাঘর, চা-কফি যা কিছু খেতে চাইলে করে নিস, পারলে আমার জন্য বরাদ্দ করিস৷
হরপ্রসাদ খানিক বিস্ময়াপ্লুত হয়ে আড়চোখে ডায়নাকে দেখল, গৃহ মালিকের আচরণ ঠিকমতো হলো না৷ মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো, গৃহকর্তা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে হাফপ্যান্ট পরে থাকবে৷ অতিথি আপ্যায়নের রীতিনীতি বেমালুম ভুলেই গেলেন৷ হরপ্রসাদ সম্ভবত উষ্ণ অভ্যর্থনা কামনা করেছিল৷
ডায়না খোস মেজাজে বলল--- এখন কফি না খেয়ে আগে তোমার বরাদ্দ ফ্ল্যাট পরিদর্শন করে নেব৷
মিনিট খানেক ফ্ল্যাট পরিদর্শন করে এসে ডায়না বিস্ময়ের সঙ্গে পরিষ্কার বললো--- কিরণদা ওই ঘরটার জানালা দিয়ে হলদি নদীর জল দেখা যায়?
কিরণশংকর বলল--- সেই জন্য তো ওই ঘরটা বরাদ্দ করেছি৷ ছোটদের মতো করতালি দিয়ে নেচে নেচে ডায়না বলল--- ক্লাসিক, দারুন!
কিরণশঙ্কর অংক কষে ভাবলো ডায়নার বয়স আপাতত ছেচল্লিশ, সাতচল্লিশ হতে পারে, তার চেয়ে ডায়না পাক্কা চৌদ্দ বছরের ছোট৷ আসলে ডায়না বয়সটাকে ভালোই লুকিয়ে রাখে৷ সহজ, সরল, স্বাস্থ্যবান, গায়ের রং শ্যামবর্ণের একটু বেশি কালো হলেও চেহারায় নান্দনিক ও বনেদীয়ানার ছাপ, সে সম্ভবত ডায়নার প্রায়ই সমবয়সী, একটু আধটু ছোট হলেও ক্ষতি নেই৷৷
ডায়না বলল--- কিরণদা ফ্ল্যাটটা ভারী সুন্দর, জায়গাটা রোমান্টিক৷ নন্দকুমার এর মতো মফঃস্বল শহরে এমন ভালো ফ্ল্যাট প্রায় অকল্পনীয়৷
কিরণশংকর বলল--- সেই সস্তার আমলে কেনা!
হরপ্রসাদ চেয়ারে বসে আরাম করলেন!
ডায়না বলল--- কিরণদা স্যান্ডোতে বসে আছো কেন? ঠান্ডা লাগতে পারে৷ কিরণশংকর বললেন--- তোরা আছিস তাই সাজগোজ খাটে না৷ কিন্তু রান্নার ব্যবস্থা ভালো নেই, বাইরে খেয়ে আসতে পারিস, উল্টোদিকে ‘বর্গভীমা’ হোটেল, ফোন করলে অনলাইন খাবার পৌঁছে দেবেন৷
ডায়না বলল--- পরে খাওয়ার চিন্তা করা যাবে, এখন খাওয়ার সময় বাকি আছে৷
জানো হরপ্রসাদ, কিরণদার সঙ্গে প্রায় দু দশক দেখাই হয়নি কিন্তু কিরণদা প্রায়ই আমাদের খোঁজখবর নিতো৷
প্রায় বাইশ বছর মাতৃভূমি ছেড়ে কলকাতা হয়ে নন্দকুমার-এ আশ্রয় নিয়েছেন, একবার ডায়না এসেছিল, তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে, সেবার ডায়না কোনও যোগাযোগ করতে পারেনি, কারণ সঠিক ঠিকানা জানতেন না৷
দেখা সাক্ষাত না হলেও খবরাখবর চলাচল করতো, ডায়নার আগের স্বামীই বিশ্বখ্যাত সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ৷ তাদের বিয়ে ও ডিভোর্স কাহিনী সবার মুখে মুখে, কিন্তু ডায়না বেড়াতে গেলে সারমেয়কে রেখে যেতেন প্রাক্তন স্বামীর হেফাজতে৷ কিরণদা বছরে প্রায়ই একবার নন্দকুমার এ আসতেন কিন্তু ডায়নার প্রসঙ্গ উত্থাপন না করলেও প্রায়ই শুনতেন৷
ডায়নার দ্বিতীয় বয়ফ্রেন্ড কবে হলো, তা অবশ্য কিরণদা জানেন না৷ এই হরপ্রসাদ সম্ভবত আর কেউ নন একটা কলেজের পাত্তি প্রিন্সিপাল মাত্র৷ যদিও পড়াশোনা আচার ব্যবহারে, বিশ্ব বিখ্যাত পৃথিবীর সর্র্বেচ্চ ডিগ্রি তার পকেটে৷
জানো, হরপ্রসাদ আমরা কিরণদার বাড়ি ভাড়া থাকতাম৷ নন্দকুমারের অভিজাত ওয়ার্ডে কিরণদার বিলাসবহুল বাড়ি, তখন কিরণদা হেব্বি ক্লাসিক স্টাইল৷ রোজ নিউ পোশাক আশাক নামিদামি পারফিউম একটা চার চাকার বেগুনি রঙের গাড়ি, মহিলা মহলে বিশাল কদর৷
কিরণশংকর হাসলেন, শরীর ভালো নয়৷ জ্বর জ্বর ভাব৷
ডায়না বলল--- সত্যিই জ্বর তো!
তুমি কি গো কিরণদা? এরকম জ্বর নিয়ে খালি গায়ে বসে আছো, ডাক্তার দেখাও একা একা থাকো, এটা অন্যায় কিন্তু৷
কিরণশংকর ডায়নার কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে বললো--- তোরা ঘরদোর গুছিয়ে নিবি তো! আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছি৷ রান্নাঘরের ও বাথরুমের কলটা চেপে বন্ধ করিস, বাথরুমের গিজার ঠিক আছে তবে উঁচুতে সুইচ বোর্ড, সাবধানে সুইচ দিস৷
শরীরের ব্যাপারে অবহেলা করে নিজের ঘরের বিছানার বালিশে মাথা দিয়ে ড. নির্মল বর্মনের উপন্যাসিকা ‘নার্সিংহোম’ পড়তে লাগলেন! আজকাল উপন্যাস ভালই পছন্দ করে, বইটা বুকে৷
ডায়না এসেছে বলেই কি পুরনো কথা মনে পড়ে যাবে, তা হতে পারে না৷ স্মৃতি রোমন্থন পছন্দ করেনা৷
ডায়না চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে, কিরণশংকরের কাছে৷ ডায়নার মতো সুন্দরী স্মার্ট রমণীর কিছু রহস্য থাকতেই পারে৷ পরে বাস্তবে ঠক্কর খেতে খেতে মানুষ ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে যায়, ডায়নাও বহু আঘাত পেয়েছেন৷
বয়ফ্রেন্ড প্রিন্সিপাল হয়েছেন, জয়েন করবেন, কোয়ার্টার পাচ্ছেন না, তাই কয়েকদিনের জন্য কিরণশংকরের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া৷ ডায়না নতমস্তকে, সুরেলা কণ্ঠে কিরণকে বলল---তুমি এরকম ময়লা অপরিচ্ছন্ন বিছানায় শুয়ে আছো কেন? বদলে দেব বিছানার চাদর!
কিরণশংকর বলল--- না বেশ তো যাচ্ছে৷
ওঠো প্লিজ এবার থেকে আমার কথামতো চলাই তোমার শ্রেয়৷
ডায়না--- এই হরপ্রসাদ তোর বয়ফ্রেন্ড না বর?
কিরণশঙ্করের হাতে হাত রেখে টুকটাক কথা বলছিল ডায়না৷ এই কথা শোনার পর হাত সরিয়ে নিয়েছিল৷ মুখমন্ডল ম্লান, মনের গোপন কথা প্রকাশ্যে আসার ফলে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল৷
কিরণশংকর অপলক নয়নে তাকিয়েছিল ডায়নার দিকে৷
ডায়না নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে ফেলল তারপর সাবলীল কায়দায় বলল--- কিরণদা তোমার কাছে গোপন করার কিছু নেই৷ হরপ্রসাদের সঙ্গে আমার ফরমাল বিয়ে হয়নি৷ হরপ্রসাদ বিবাহিত ওর মিসেসের সঙ্গে প্রায় আট বছর কোন সম্পর্ক নেই৷ কিন্তু সে ভদ্রমহিলা কিছুতেই ডিভোর্স দেবেন না৷ হরপ্রসাদ বস্তুতঃ আনহ্যাপি৷ কিন্তু মামলা করা উচিত নয়, যদি কোনদিন মিউচুয়াল ডিভোর্স পাওয়া যায়৷ সেই অপেক্ষায় আমরা আশা করি৷ কিরণদা সবকিছু বুঝতে পারবে৷
কিরণশংকর হালকা ভাবে বললে--- কি আর হয়েছে? প্রায়ই তো এরকমই হয়৷
ডায়না বলল--- অনেকে প্রায়ই ভুল বুঝবে কিন্তু হরপ্রসাদ আমার জন্য ডিভোর্স দিতে যাবে না! আমি কারোর বিয়ে ভেঙ্গে নতুন করে গড়তে চাই না৷ আমার সঙ্গে পরিচয়ের পূর্বে মিসেসের সঙ্গে বনিবনা বন্ধ, ওদের স্টাইল এর মধ্যে ব্যাপক সমস্যা৷
কিরণশংকর বললেন--- প্রায়ই এরকমই ঘটে!
ডায়না বলল কিরণদা, এই হরপ্রসাদ মাটির মানুষ, মন ও ধন দুটো যথেষ্ট ভালো৷ তার ওপর রাইটার৷ কবিতা ও সাহিত্যচর্চায় প্রায় মশগুল থাকেন৷ ফলতঃ মানুষটি খুবই ভালো, তাই চেনাশোনা মানুষের থেকে আড়ালে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই৷ এখন মাঝে মাঝে মনে হয় সবই আমার ভাগ্যের দোষ৷ ডায়না একটা নিজের মনের মতন সংসার চেয়েছিল, জুটলো না৷ নতুন করে জীবন শুরু করতে চায়৷
চোখের জলে কাজল ভিজে একাকার ডায়নার৷ সব কথা মুখ ফুটে বলা যায় না, তার রূপ গুণ যৌবন থাকা সত্ত্বেও জীবন তাকে যথেষ্ট দেয় নি৷ কিরণশঙ্কর পরিষ্কারভাবে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন--- ডায়না ভালোইতো নতুনভাবে ক্লাসিক আঙ্গিকে জীবন শুরু করিস---
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.