গল্প

গল্প অভিমান

অভিমান

লেখক : তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

বিকেলের মরা আলো দ্রুত চুঁইয়ে পড়ছে জঙ্গলের ঝাঁকড়া ডালপালা-পাতালতা বেয়ে, দু-চার ফোঁটা আঁাঁধারও জমতে শুরু করেছে ডালপাতার ফাঁকফোকরে, এ সময়ে আঁাঁধার বাড়তে থাকে চক্রবৃদ্ধিহারে, কখন যে লাফিয়ে পড়ে ঘিরে ধরবে তার ঠিক নেই৷ জিপ তখন ছুটছে দুর্ন স্পিডে৷ চলন্ত জিপে টেনসনায়িত হয়ে দীপিকা ঝাঁজিয়ে উঠল, পৌঁছোতে সেই রাত হয়ে যাবে, তোমাকে কখন থেকে তাড়া দিচ্ছিলাম, দু-ঘন্টা আগে বেরোলে এমনটা হত না, সন্ধের আগেই পৌঁছে যেতাম বাংলোয়

কোনও কথা বলল না ঋত্বিক, চারপাশে ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে জঙ্গলের গাছগাছালিরা, শাল-সেগুন-অর্জুনের বুনোগন্ধ নাকের লতি বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল স্নায়ুর গভীরে, তাতে অবশ হয়ে আসছিল তার চেতনা৷ জঙ্গলে এলে তার প্রতিবার এমনটি হয়৷ জঙ্গলের সঙ্গে এমন একটা ভালোবাসাবাসি আছে, সেই টান-ভালোবাসার টানে সে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে৷ এর আগে বেতলা- পালামৌতেও সে এমনই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, তখন ছিল একা, এখন সঙ্গে দীপিকা আর টুটুল৷

দীপিকারা সঙ্গে থাকলেও তার ভিতরে জঙ্গলের সেই সম্মোহন উপচে ওঠে কি না সেটাই পরখ করতে চাইছিল ঋত্বিক৷ দীপিকার একদম ইচ্ছে ছিল না জঙ্গলে রাত কাটাতে৷ জঙ্গল দেখলে তার ভিতরে নাকি উপচে ওঠে এক অদ্ভুত আতঙ্ক৷ ঘন জঙ্গলের বুক চিরে পাকা রাস্তা চলে গেছে চালসার দিকে৷ দুপাশে অসাড় জঙ্গল বলে চারপাশ থমথমে৷ যে বনবাংলোয় তাদের গন্তব্য তার প্রাঙ্গণে ক-দিন আগে একটা পোষা হাতি হঠাৎ খেপে গিয়ে তার মাহুতকে আছড়ে মেরে ফেলায় বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল খবরের কাগজে, তার পর থেকে এই বনবাংলোয় পর্যটকের সংখা কম৷ কাছাকাছি হলং-এর থাকার ব্যবস্থা অনেকটাই নিরাপদ হওয়ায় ট্যুরিস্টদের টান ওখানে৷ হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গল পরিদর্শনের উত্তেজনাই হলঙের অধিকতর আকর্ষণ৷ সেরকমই আভাস দিয়েছিলেন ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার৷ কিন্তু ঋত্বিক একটু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হওয়ায় সে বেছে নিয়েছে এই অপেক্ষাকৃত রোমাঞ্চকর অথচ কম-বিখ্যাত জঙ্গলটি৷ বলেছিল, জঙ্গলে নির্জনতা না থাকলে তার চার্ম কোথায়৷

লাটাগুড়ি পেরোবার পর থেকেই একটা ঘোর গ্রাস করছে তাকে৷ গাড়ির সামনে বয়স্ক ড্রাইভার সুরেশবাবু মধ্যম গতিতে চালাচ্ছেন নির্বাক ভঙ্গিতে, কখনও ঋত্বিক তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিচ্ছেন যতটা জানেন৷ গতবার ইলেকশনে ময়নাগুড়িতে গোলমাল হয়েছিল, লাটাগুড়ি জায়গাটা চোরাকারবারিদের আস্তানা--- যাকে বলে ডেন, ধূপগুড়িতে যাওয়ার পথে ঠিক যেখানটায় রাস্তা দু-ভাগ হয়ে গেছে সেখানে একটা বিশাল দুর্ঘটনা ঘটেছিল কিছুদিন আগে এরকম টুকরোটাকরা নানা তথ্যে সমৃদ্ধ করছিলেন ঋত্বিকদের৷ কিন্তু লাটাগুড়ি পেরোনর পর তিনিও কী কারণে যেন চুপচাপ৷ হয়তো জঙ্গলের থমথমে ভাবটা ক্রমশ বাড়ছে বলেই৷

আট-ন মাইল জঙ্গলের রাস্তায় সেঁধুবার পর দীপিকা বেশ সন্ত্রস্ত, বেশ ঝাঁজ ফুটে উঠছে তার অভিব্যক্তিতে, এর মধ্যে দু-বার বলাও হয়ে গেছে কেন এই ভয়ভীতির মধ্যে অ্যাডভেঞ্চার করা ফাঁকা পিচরাস্তায় হু হু চলছিল জিপটা, হঠাৎ কী কারণে যেন স্লো হয়ে গেল গতি৷ ডাইনে একটা বড়ো সুঁড়িপথ যেখানে রওনা দিয়েছে আরও গভীর জঙ্গল লক্ষ্য করে, সেখানেই একটা ছোট্ট হোর্ডিং অভয়ারণ্যের নাম উল্লেখ করে৷ সেই সুঁড়িপথে জিপ ঘুরে যেতেই ডাইনে ফরেস্টের ছোট্ট গার্ড অফিস, হর্ন বাজাতে বেরিয়ে এল এক ছোকরা গার্ড, হাতে অনুমতি-খাতা, ডি এফ ও-র ইস্যু করা পাশ দেখিয়ে তবে ভিতরে যাওয়ার সিগনাল৷ ঋত্বিক যখন ফরেস্টের খাতায় নিজের অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত, ছোকরাটি তার অফ হোয়াইট দাঁত দেখিয়ে বলল, ভালো দিনে এসেছেন বাবুরা, আজ একটা বড়ো দল বেরিয়েছে জঙ্গলে৷ একটু আগে এই গার্ড অফিস হেলিয়ে দিয়ে চলে গেল ভিতরে৷

তার অঙ্গুলিহেলনে চোখে পড়ে কাঠের গার্ড অফিস অনেকটাই হেলে গেছে, প্রায় তিরিশ ডিগ্রির মতো, সেই কার্নিক খেয়ে পড়া ছোট্ট অফিসটি যে এখনও পুরো শুয়ে পড়েনি মাটিতে সে ছোকরা গার্ডের নিতান্তই বরাত, না হলে তাকে এতক্ষণ হাসপাতালে দিতে হত এরকম একটি বয়ান তাদের উদ্দেশে দিতেই দীপিকা তার চোখে পর্যায়ক্রমে ত্রাস ও আগুন জ্বেলে তাকায় ঋত্বিকের দিকে৷ দলটি যে বুনো হাতির তা অনুমান করে সাত বছরের টুটুলও বেশ সন্ত্রস্ত৷

ঋত্বিক অনায়াসে বলল, আর কিছু করার নেই, জলপাইগুড়ি থেকে এতখানি পথ এসে এখন তো আর ফিরে যাওয়া যায় না, রাতটা এখানেই কাটাতে হবে৷ আর জঙ্গলে এসে একটা বুনোহাতির দঙ্গল দেখতে পাওয়া তো ভাগ্যের কথা৷

কিন্তু বুনো হাতি যে আদপেই শৌখিন মজদুরি নয় তা ঋত্বিক জানে, জানে বলেই এতক্ষণে অ্যাডভেঞ্চারটা সামান্য ত্রাসের সঞ্চার করল তার মনেও৷ টুটুল কৌতূহলী চোখে ফালুকফুলুক করে উপভোগ করছিল জঙ্গলের পটভূমি, সেও একটু পরে রাস্তার দু-ধারে বুনোহাতির দল চলে যাওয়ার দৌরাত্ম্য চাক্ষুষ করে হঠাৎ বলল, জঙ্গলটা একটা জুজুবুড়ি, তাই না, মা?

ঋত্বিক পরিস্থিতি হালকা করতে বলে উঠল, তবু আমাদের পৌঁছোনর কিছু আগেই যে তেনারা রাউন্ড দিয়ে গেছেন সেটাও আমাদের বরাত৷ কী বলো?

দীপিকা স্বরে আরও ঝাঁজ মিশিয়ে বলল, বিপদের গহ্বরের মধ্যে পৌঁছে রসিকতা করাটা মোটেই সাজে না৷ তোমার কী যে সব উদঘট পরিকল্পনা মেয়ে-বৌ নিয়ে জঙ্গলে রাত কাটাতে হবে৷ তাও এমন জঙ্গলে যেখানে বুনোহাতির দঙ্গল সারাক্ষণ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যারা ভাঙচুরে অভ্যস্ত৷

জিপ তখন হু হু করে জঙ্গলের খাঁড়িপথ বেয়ে সেঁধুচ্ছে ভিতরে৷ দু-পাশে এমন ঘন ঝোপ আর বড়ো বড়ো গাছ ঝুঁকে আছে সরু রাস্তার উপর যেন সত্যিই কোনও গহ্বরের মধ্যে তারা ঢুকে পড়ছে ক্রমশ৷ দীপিতার আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়, এ জেলার এই বনবাংলোটায় ট্যুরিস্ট আসে সংখ্যায় কম যদিও বুনো হাতি ছাড়া বাইসন ইত্যাদি নানবিধ জন্তুর আনাগোনা দেখাও এখানকার অন্যতম আকর্ষণ৷ ট্যুর প্রোগ্রাম তৈরি করার সময় এত কিছু ভাঙেনি দীপিকার কাছে৷ ঋত্বিক তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে জঙ্গলের ভয় ভাঙতে হলে বেশি-বেশি জঙ্গলে যাওয়াটাই দস্তুর৷ হাতির দঙ্গল একটু আগেই জঙ্গল তোলপাড় করতে করতে গেছে তা দু-পাশের ঝোপঝাড়ের পিষ্ট হওয়া দেখেই অনুমান করতে পারছে ওরা৷ পদপিষ্ট সবুজের ভিতর থেকে তাই এমন একটা গন্ধ বেরোচ্ছে যা সচরাচর বেরোয় না৷ সেই গন্ধে ঋত্বিকের মনে মন-উচাটন করা এক ধরনের অনুভূতি৷ মিষ্টি ঝাঁজালো গন্ধটা গ্রাস করছে তার স্নায়ুকেন্দ্র৷ গন্ধটা বাকি কেউ পাচ্ছে না বলেই উপভোগ করতে পারছে না এ হেন অভাবনীয় সুযোগ৷

কপাল ভালো যে বাকি ছ-কিলোমিটার পথে হাতিদের গমনছবি চাক্ষুষ করা গেলেও মুখোমুখি হতে হয়নি একবারও৷ হলে কী হত তা আর ভাবতে চাইছে না ঋত্বিক৷ হঠাৎ একটা কাঠের গেটের সামনে পৌঁছে ক্যাঁ-চ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে সুরেশবাবু চেঁচিয়ে কাকে যেন ডাকতেই ভিতর থেকে হারিকেন ও চাবি হাতে বেরিয়ে এল ঝাঁকড়াচুলো একটি ডাকাবুকো চেহারার যুবক৷ দরজা খুলে দিতে ভিতরে একটি চওড়া পরিখা, তার উপর দিয়ে গাড়ি পারাপারের পাটাতন, সেটি সারাক্ষণ ওঠানোই থাকে, ঋত্বিকদের গাড়িটা পাটাতনে উঠে একটা মস্ত ঝাঁকুনি দিয়ে গড় গড় করে পার হয়ে যেতেই পিছনের গেট বন্ধ হয়ে গেল, পাটাতনটিও উপরে উঠে গিয়ে বাইরের জঙ্গলের সঙ্গে ভিতরের বাংলোর মধ্যে সৃষ্টি করল একটি বড়োসড়ো ব্যবধান৷ সামনে সেই বনবাংলো যার কথা ঋত্বিক একদিন নাগাড়ে বলেছে দীপিকাকে, যার গুণগান করে বলেছে, ‘এই বনবাংলোয় রাত কাটানোর মতো রোমান্টিক মুহূর্ত আর দ্বিতীয়বার পাবে না৷’ সেই বাংলোয় পৌঁছেও অবশ্য দীপিকার মেঘমুখে একটুও রোমান্টিকতার বিদ্যুৎ-চমক নেই, বরং বাংলোর বারান্দায় উঠে অন্ধকারের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে রইল বিমূঢ়৷

ঋত্বিক দু-চোখ ভরে দেখছিল পুরো কাঠের তৈরি চমৎকার দোতলা বাংলোটি৷ দোতলায় পাশাপাশি দুটো শোওয়ার ঘর, নীচে কিচেন ও ডাইনিং৷ বাংলো থেকে অদূরে পরিখার সীমানার মধ্যে আরও কয়েকটি ছোটো ছোটো কাঠের বাড়ি, সেগুলো সবই গার্ড আর অ্যাটেন্ড্যান্টদের থাকার জায়গা৷ যে-যুবকটি তাদের গেট খুলে দিয়ে নিয়ে এল বাংলোয় সেও নিশ্চয় এখানকার একজন কর্মী, বাংলোর ঘর খুলে সবকিছু বুঝিয়ে দিল হাতের হারিকেনটি উঁচু করে ধরে৷ জিজ্ঞাসা করতে নিজের নাম বলল জংলা খোয়েরি, সবাই তাকে জংলা বলেই ডাকে৷

---দারুণ নাম তো জংলা৷ জঙ্গলের দেশে এরকম জঙ্গুলে নামই তো ভালো৷

ঋত্বিকের সঙ্গে দীপিকাও তাকিয়ে দেখে যুবকটির শরীরের টানটান কাঠামো৷ কালো রঙের মধ্যে ঝকঝকে চেহারা, একমাথা এলোমেলো চুল--- দূর থেকে অশ্বথগাছের পাতাভরা ডালপালা দেখলে যেমনটি মনে হয় সেরকম ঝাঁকড়া৷ সবচেয়ে দেখার মতো ওর চোখদুটো--- ডাগর, উজ্জ্বল৷ যা আরও নজরে পড়ল তার হাঁটাচলায় ক্ষিপ্রতা, কাজেকর্মেও ভীষণ চটপটে৷ মুহূর্তে সারা মেঝে ঝাঁট দিয়ে বিছানায় ধবধবে বেডশীট পেতে, বালিশে সাদা ওয়াড় পরিয়ে ঘর সাজানোর পাট শেষ৷ টেবিলের জগে জল ভরে দিয়ে বলল, একটু রেস্টো নিন, স্যার, আমি হাতমুখ সাফা করার জন্য বালতিতে জল ভরে নিয়ে আসছি৷ জল সেই খাদের নীচে৷ আমি এসে আর একটা হেরিকেন জ্বেলে দিচ্ছি’ বাংলোর ট্যাপে জল নেই শুনে দীপিকা প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে কেন না জলটাই তো সবচেয়ে আগে দরকার৷ জংলা হুড়মুড় করে দু-হাতে দুটো বড়ো বালতি নিয়ে নীচের টিউবওয়েল থেকে জল ভরে নিতে সেই অন্ধকারে খাদের দিকে ছুটল জোর পায়ে৷

সন্ধে পার হয়ে গেছে, অথচ ঘরে ইলেকট্রিক নেই এটুকু বুঝতে সামান্য সময় লেগে গেল দীপিকার, কেন না জংলা বালতি হাতে নিয়ে অন্তর্হিত হওয়ামাত্র বাংলোর একমাত্র হারিকেনটি জঙ্গল ছুঁয়ে ছুটে আসা হাওয়ার দমকে নিভে গেল, সঙ্গে সঙ্গে বিপুল অন্ধকার কেউ উপুড় করে ঢেলে দিল ঘরের মধ্যে৷ বিষয়টি আত্মস্থ করে দীপিকার পুনর্বার আর্তনাদ, ইলেকট্রিক নেই সে কী এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে থাকতে হবে নাকি?

ঋত্বিক গায়েই মাখল না কথাটা, একঘর অদ্ভুত আঁধার থেকে বেরিয়ে এল বারান্দায়, সেই আঁাঁধার ঋত্বিকের কাছে ভারী উপভোগ্য লাগছে এই মুহূর্তে, দীপিকার কথা একটুকরো হাসি ছুড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, বাহ জঙ্গলে বাস করতে এসে তুমি যদি শহরের সব ফেসিলিটি চাও, তা হলে কী করে হবে? জঙ্গল তো জঙ্গলই৷ মোটে একটা রাত, এখানে এসে একটু জঙ্গুলে হয়ে গেলেই তো হয় চোখ বাড়িয়ে দ্যাখো তো, আকাশে একফালি কাস্তে-প্যাটার্নের চাঁদ সেগুন গাছের ডগায় কী দারুণ ধবধবে জ্যোৎস্না ফোটাচ্ছে সেই জ্যোৎস্না ঠিকরোচ্ছে নীচের ঘাসে, অফুরন্ত ঝোপঝাড়ে৷ ---কোথায় জ্যোৎস্না দীপিকার চোখে যেন দূরবীন, জঙ্গলে চাঁদের আলো খুঁজতে থাকে, না-পেয়ে বলল, তোমার চোখ দিয়ে আজ দিব্যজ্যোতি বেরোচ্ছে তাই অন্ধকারের মধ্যেও জ্যোৎস্না দেখছ আজ

ঋত্বিক তেমনই নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বলল, জ্যোৎস্নার কারুকাজ না দেখতে পাও, জঙ্গল থেকে শালসেগুনের বুনোগন্ধ তো পাচ্ছ নিশ্চয়ই৷ তাও যদি না পাও তো মহুয়ার গন্ধ কি পাচ্ছ না? একটা অদ্ভুত ঝাঁজ-মেশানো মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে না বাতাসে?

দীপিকা বিভ্রান্ত হয়ে বলল, তোমার নাকে অনেক কিছুর গন্ধ লাগে, কিন্তু আমার নাক বোধহয় ভোঁতা, গন্ধ ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে বেরিয়ে যায় পাশ দিয়ে৷

ঋত্বিক দীপিকাকে শান্ত করতে কয়েক চামচ মস্করা ছুড়ে দেয়, আলতো করে হেসে বলে, ভোঁতা কোথায় তোমার নাক তো দিব্যি টিকোলো৷ টিয়ার আগের স্টেজ৷

---রাখো তোমার ইয়ার্কি৷ এখন তিনি কখন এসে আলো জ্বালবেন কে জানে আমি আবার দেশলাইও আনিনি৷ ব্যাগে একটা টর্চ আছে না? এই অন্ধকারে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঋত্বিক অনায়াসে বলল, টর্চ তো ইচ্ছে করলেই জ্বালা যায়৷ কিন্তু না-জ্বেলে বারান্দায় এতগুলো চেয়ার পাতা আছে, একটু বসা যাক না লেট আস এনজয় দি ডার্কনেস অন্ধকারেরও একটা সৌন্দর্য আছে তা দু-চোখ ভরে দ্যাখা যাক৷ জংলা এলে আবার হারিকেন, না না ওই যে কী বলল হেরিকেন, হেরিকেন জ্বেলে দেবে৷

নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে ঋত্বিক, তিনটে চেয়ার টেনে নিয়ে পাশাপাশি বসতে উদ্যোগী হয়, দীপিকা আর টুটুল বসতে বলল, একটা তো মোটে রাত, জঙ্গলে এসে না হয় ওদের মতো একটু জঙ্গুলে হয়ে কাটালাম
টুটুল হঠাৎ বলল, বাবা, এই জঙ্গলে গুপ্তধন আছে?

---গুপ্তধন এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে ঋত্বিক বলল, জঙ্গল নিজেই তো একটা মস্ত গুপ্তধন৷ এত-এত গাছগাছালি, ফুল, পাখি, জন্তুজানোয়ার---একদা এ সবই তো লুকোনো ছিল এখানে৷ আজই অবিষ্কার করলাম আমরা তাই না? এই ঐশ্বর্য কি কম কারও চেয়ে---

তার কথা শেষ না হতে তিনির আবির্ভাব৷ জংলা তার হাতের ভরা বালতিদুটো বাথরুমে নামিয়ে দিয়ে বলল, হেরিকেনটা নিবে গেছে নাকি? ইস, আপনেদের কত কষ্ট হল দাঁড়ান, আমি আবার জ্বেলে নে আসি৷

ঋত্বিক হঠাৎ বলল, এখানে বাইসন আছে না, জংলা? শুনেছি রাতে বাইসন বেরোয়৷

---সে অনেক রাতে আসবে৷

টুটুল মা-বাবার মধুর বাক্যাবলি শুনছিল হাঁ করে, জিজ্ঞাসা করল, বাইসন কী বাবা? জুজুবুড়ি?

জংলা আলো জ্বালতে চলে গেল কোথায় না কোথায়, ঋত্বিক বলল, বাইসন একধরনের বনের পশু৷ মহিষের মতো দেখতে৷ ততো হিংস্র প্রাণী হিসেবে খ্যাতি আছে৷
---নে টুটুল চুপ মেরে গেল হঠাৎ, তারপর বলল, কামড়ায়?
---না৷ কামড়ায় না, তবে ওদের শিং খুব বিপজ্জনক, মানুষ সামনে পড়লে গুঁতিয়ে দিতে পারে৷

দীপিকা তৎক্ষণাৎ বলল, তা হলে বাইসন দেখে কাজ নেই৷

জংলা ফিরে এল দু-হাতে দুটো হারিকেন ঝুলিয়ে, তারই একটা বারান্দায় রেখে অন্যটা রেখে এল বেডরুমে৷ কিন্তু যা ফিচেল হাওয়া, হারিকেন জ্বেলে রাখে কার সাধ্য৷ বারান্দার হারিকেনটা তৎক্ষণাৎ দপদপ করে উঠল৷ সেদিকে নজর ন্যস্ত রেখে জংলা বলল, খাদের উপর থেকে দেখলে কোনও ভয় নেই, ম্যাডাম৷ ওরা থাকে অনেক নীচে৷

দীপিকা বলল, তুমি নীচে থেকে জল আনতে গেলে না?ওখানে বাইসনের ভয় নেই?

জংলা হেসে উড়িয়ে দিল দীপিকার আশঙ্কা, বলল, আমাদের শরীরে ভয়ডর থাকতে গেলে চলে না৷ আমাদের অব্যেস হয়ে গেছে৷ কতবার হাতির সামনে পড়েছি কী খাবেন স্যার, ডিম, না মুরগি?

---এখন মুরগি পাওয়া যাবে?ডি এফ ও অবশ্য বলেছিলেন বাংলোয় একটা ছোট্ট পোলট্রি আছে৷ সব পাওয়া যায়৷ মুরগিই করো তাহলে?

জংলা তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করল তাদের রান্নার ব্যবস্থায় নিয়োজিত হতে, যাওয়ার আগে বলল, তেইশদিন পরে কেউ এলেন এই বাংলোয়৷ কেউ না এলে কেমন হাঁপ ধরে যায় বুকে জংলার রকমসকম ভারী পছন্দ হচ্ছিল দীপিকার, খুব সরল আর জঙ্গুলে চেহারার, বলল, তুমিও আমাদের সঙ্গে খেয়ে নিও, জংলা৷

জংলা মস্ত করে ঘাড় নেড়ে তাদের মেনু জেনে নেয়, সে বেরিয়ে যেতেই সুরেশবাবু নীচে কোথাও ছিলেন, উঠে এসে ঋত্বিককে বললেন, স্যার, বাইসন দেখবেন চলুন৷

বাইসনের দৃশ্য দেখতে অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিল ঋত্বিক, লাফিয়ে উঠে বলল, বাইসন দেখা যাবে এখন? চলুন, সুরেশবাবু, বাইসন দেখতেই তো এখানে আসা৷

দীপিকা ততক্ষণে বাথরুমে অন্তর্হিত, হাতমুখ ধুয়ে বেরোতেই ঋত্বিক বলল, রান্না হতে এখনও ঢের দেরি৷ চলো, আগে বাইসন দেখে আসি৷ জংলা বলল বাংলোর চত্বরে কোনও ভয় নেই৷

বাইসনের টানে-টানে সবাই নেমে এল বাংলোর সামনে একটি ইঁট-বিছোন সরু রাস্তায়৷ সামনে সুরেশবাবুর হাতে একটা টর্চ, তার পিছু পিছু টর্চের আলোয় বহু অন্ধকার চিরে তবে খাদের সামনে এসে হাজির হতে পারল তারা৷ নীচে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, এই বিপুল প্রকৃতির রাজ্যে সামান্য হলেও জ্যোৎস্নার আলো মায়া ছড়াচ্ছে তা এতক্ষণে চোখ পড়ল দীপিকারও৷ সেই মায়াবী আলোয় একটি উঁচু জায়গা দেখিয়ে সুরেশবাবু বললেন, ওইটে নুনবেদি৷ ফরেস্ট গার্ডরা রোজ সকালে নুন রেখে আসে তেনাদের জন্য৷ সন্ধের পর নুন খেতে আসেন তেনারা৷

কিন্তু নুনবেদি আপাতত ফাঁকা, বাইসনরা কেউ নুন খেতে আসেনি এখনও৷

হতাশ টুটুল মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জুজুবুড়ি এখনও আসেনি, বাবা?

ঋত্বিকও মাথা ঝাঁকায়, না৷ চলো, ততক্ষণ আমরা বাংলোর চারপাশটা ঘুরেঘরে দেখি৷

বাংলোর চারপাশে পরিখা থাকায় কোনও বুনোহাতি ভিতরে আসতে পারবে না, বাইসনরাও খাদের খাড়া দেওয়াল বেয়ে আসতে পারবে না উপরে৷ বুনোজন্তুরা যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্বে রয়েছে নিঃসন্দেহ হওয়ায় ততক্ষণে দীপিকা বেশ ফুর্তিতে৷ বলল, কী নির্জন জায়গাটা, তাই না?

দীপিকা তখন জ্যোৎস্নার সামান্য আলোয় আবিষ্কার করতে চাইছে জঙ্গলের রহস্য৷ অত বড়ো বাংলোতে টিমটিম করছে মাত্র একটি হারিকেন৷ দূরের রান্নাঘরে চলছে মুরগির নিধনপর্ব ও রান্নার প্রস্তুতি৷ বাংলোর পাশে ছোটো কাঠের বাড়িগুলোয় তখন ফরেস্ট গার্ডদের ছোটো ছোটো সংসারে চলছে রাতের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন৷ কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে দীপিকা বলল, দেখেছ, এখানে সন্ধে উতরোতে না উতরোতে সব খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে৷ কী করবে বেচারিরা?

কিছুক্ষণ এতোলবেতোল ঘুরে ওরা ফিরে এল বাংলোয়, কিছুক্ষণ বারান্দায়, কিছুক্ষণ ঘরে গল্পগুজব করার ফুরসতে জংলা চলে এল পাত্রে ভাত-মুরগির ঝোল সাজিয়ে৷ ঋত্বিক তার সুগন্ধ নিশ্বাসে ভরে নিয়ে বলল, দারুণ রেঁধেছে তো জংলা৷

দীপিকা বলল, কী, এখনই খেয়ে নেবে নাকি?

---এখনই ঋত্বিক কব্জিতে চোখ রাখে, সবে রাত আটটা৷ অন্তত নটা-সাড়ে নটা হোক৷ সকালে উঠেই তো চলে যাওয়া৷ আর একটু এনজয় করি জঙ্গলটা

দীপিকা সায় দিয়ে দ্বিগুণ ফুর্তিতে বলল, চলো তো, দেখে আসি বাইসনগুলো এল কি না?

দীপিকার আগ্রহ দেখে ঋত্বিক ভারী পুলকিত, যাক, দীপিকা তা হলে জঙ্গল পছন্দ করতে শুরু করেছে আবার খাদের দিকে ওরা এগোয়, আগের চেয়ে জ্যোৎস্নার সাজ আর একটু বেড়েছে এখন৷ নীচের খাদে রুপুলি রঙের ঝরে পড়া দেখে টুটুল বলল, কী সুন্দর লাগছে, বলো মা?

দীপিকা তখন আবিষ্কার করে ফেলেছে দূরে নুনবেদির কাছে জোড়ায় জোড়ায় আলো জ্বলছে কীসের যেন সেদিকে ঋত্বিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সে বলে ওঠে, আ রে, ওই তো বাইসনের দল টুটুলও দেখল সেই জ্বলন্ত চোখের রাশি আধো-অন্ধকারে জ্বলছে টর্চের মতো৷ তার কণ্ঠে সামান্য ভীতির ছাপ, বলল, কী সাংঘাতিক দেখতে, তাই না?

ওরা আরও বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্যের দিকে, সেই দৃশ্য পান করে রুপোরং জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশিয়ে৷ ফিরল অনেকক্ষণ পরে৷ ফিরেই ঋত্বিক বলল, এসো, এবার খেয়ে নেওয়া যাক৷ রাত কিন্তু কম হয়নি৷

একদিকে সুরেশবাবু, অন্যদিকে ওরা তিনজন, খাওযা শুরু করার আগে দীপিকা বলল, জংলাকে ডেকে ওর খাবার দিয়ে দিলে হত৷

ঋত্বিক বলল, ও নিশ্চয় এখনই খোঁজ নিতে আসবে৷ ওর জন্য আলাদা করে গুছিয়ে রাখো৷ আমরা খেতে শুরু করি৷ এতক্ষণ জঙ্গলে ঘুরে ফুরফুরে হাওয়ায় দিব্যি খিদে পেয়ে গেছে আমার৷ খিদে অবশ্য প্রত্যেকেরই পেয়েছে তা বোঝা গেল ওদের খাওয়ার বহর দেখে৷ মুরগিটা ভালোই রাঁধে জংলা, ঝোঁকের মাথায় অনেকটা ভাত খেয়ে নিল ঋত্বিক৷ খাওয়ার শেষে ঋত্বিক বলল, সুরেশবাবু, জংলা কিন্তু এল না এখনও৷ আপনি ওকে ডেকে নিয়ে আসবেন?

কিন্তু সুরেশবাবু ডাকতে গেলেন তো গেলেনই, ফেরার নাম নেই, অনেকক্ষণ পরে এসে বললেন, সার, জংলা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, বাকিরা সবাই চেষ্টা করেও জাগিয়ে তুলতে পারল না, বলল, জংলা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল আমরা ওকে ডাকব ভেবে৷ তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে৷ জঙ্গলে এত রাত পর্যন্ত তো কেউ জাগে না৷

দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে সুরেশবাবুর দিকে৷ দীপিকার মুখে আবার মেঘ, বলল, তোমাকে তখনই বলেছিলাম ডেকে আনতে হয়তো তখনও জেগে ছিল ও৷ ইস বেচারি, হয়তো আমাদের সঙ্গে খাবে বলে নিজের জন্য কিছু রাঁধেনি আজ শেষপর্যন্ত খাওয়াটাই হল না ওর৷

ঋত্বিক বলল, কী আর করা যাবে৷ কাল ফেরার সময় কিছু টাকা দিয়ে দিও বকশিশ হিসেবে৷

রাতটা বেশ উৎকণ্ঠায় কাটল ওদের৷ পরদিন জংলার মুখের দিকে ওরা তাকাতেই পারছিল না, কিন্তু জংলার কোনও বিকার নেই যেন, তেমনই প্রশান্ত মুখে সকালের চা দেওয়া, খাদের নীচ থেকে বাথরুমে জল ভরে দেওয়া--- একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছিল যেমন করেছিল কাল সন্ধেয়৷ ফেরার সময় হলে ঋত্বিক একশোটা টাকা বকশিস হিসেবে দিতে গেল, জংলা তেমনই নির্বিকার মুখে বলল, ওটা রাখে দেন, বাবু, আমরা তো কাজ করার জন্য মাইনে পাই৷

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.