প্রবন্ধ

প্রবন্ধ কলকাতার লুপ্তপ্রায় সিনেমাপাড়া

কলকাতার লুপ্তপ্রায় সিনেমাপাড়া

লেখক : সৌরভ চাকী

কলকাতা আধুনিক হচ্ছে বলা ভালো আধুনিক হচ্ছে আজকের প্রজন্ম।আর তাদের হাত ধরে আধুনিকতার মোড়কে হারিয়ে যেতে বসেছে কলকাতার ঐতিহ্যশালী ল্যান্ডমার্কগুলো। বিশ্বায়নের যুগে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কলকাতার এই যে অভিযোজন তার ফলস্বরূপ অনেক ঐতিহ্যই আজ চলে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়,রয়ে যাচ্ছে শুধুই কিছু নস্টালজিক স্মৃতি।

আজ বলবো কলকাতার লুপ্তপ্রায় সিনেমা পাড়ার গল্প। কলকাতা জুড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ও থিয়েটারগুলোর কথা। যেগুলো এখনও কোনওক্রমে টিকে আছে তাদের অবস্থাও তথৈবচ। মাল্টিপ্লেক্স,আইনক্স,নেটফ্লিক্স,হটস্টারের যুগে এইসব হল,থিয়েটার আজ ব্রাত্য। আশি,নব্বইয়ের দশকে যে কলেজ পড়ুয়ারা এই হলগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিল তাদের উত্তরসূরিরা আজ এই হল বিমুখ। মাল্টিপ্লেক্সের ঝাঁ চকচকে স্ক্রিনে আর তার রেঁস্তোরার ডাইনিংয়ে ট্রিট দেওয়াটাই আজকের স্ট্যাটাস সিম্বল।তাই ওই সব পুরানো ব্যাকডেটেড তকমা পাওয়া হলগুলোর আজ পঞ্চত্বপ্রাপ্তি।

সেই যুগে সমস্ত কলকাতা জুড়ে মানুষের সিনেমা প্রীতি থাকলেও উত্তর কলকাতা ছিল এব্যাপারে অনেক এগিয়ে।উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চল একসময়ে বিখ্যাত ছিল তার সিনেমা আর থিয়েটারের জন্য। জায়গাটির নামই হয়ে গেছিল সিনেমা পাড়া। সারকারিনা,রঙ্গনা,বিশ্বরূপা,বিজন প্রভৃতি থিয়েটারগুলো বেশিরভাগই ছিল রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটের উপর আর সিনেমাহলগুলো ছিল ঠিক বিপরীতেই । বড় রাস্তার  উপরেই ছিল রূপবানী,রাধা,উত্তরা,শ্রী,মিত্রা,মিনার,দর্পণা ইত্যাদি। রংমহল, ষ্টার থিয়েটার ছিল আগেকার কর্নওয়ালিস স্ট্রিট বা বর্তমানের বিধান সরণির উপর।রংমহল,রূপবানী ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে শপিং মল,আবাসন। যদিও রাজ্য সরকারের সহায়তায় বেঁচে রয়েছে আধুনিকতার মোড়কপ্রাপ্ত ষ্টার থিয়েটার। অথচ এই হল,থিয়েটারগুলোর অনেক ঐতিহ্য ছিল।প্রতিটির নুন,ম্যাটিনি আর ইভিনিং শো চলতো রমরমিয়ে।প্রতিটি শোয়ের দর্শক শ্রেণীও ছিল আলাদা।এদের মধ্যে অনেক হলই ছিল উত্তর,মধ্য,দক্ষিণ কলকাতা সিনেমার চেইনের অন্তর্গত।নতুন সিনেমা একসাথে মুক্তি পেত মিনার-বিজলি-ছবিঘর,শ্রী- প্রাচী-ইন্দিরা,উত্তরা-উজ্জ্বলা-পূরবীতে।শুক্রবার নতুন কোনো ছবি রিলিজ করলে বুধবার থেকেই অ্যাডভান্স টিকেটের জন্য লম্বা লাইন পড়তো। উত্তম-সুচিত্রার বা উত্তম-সুপ্রিয়ার নতুন ছবি মুক্তি পেলে টিকিটের চাহিদা থাকতো তুঙ্গে।টিকিট কাউন্টারে ঝুলতো হাউসফুল বোর্ড। ব্ল্যাকারদের দেখা যেত অলিতে গলিতে পুলিশের সাথে লুকোচুরি খেলতে। সে সব আজ ইতিহাস। বাড়ির মহিলারা রাতের শো দেখতে গেলেও নিরাপদ ছিল সে কলকাতার রাত।

এবার আসি সেই বাংলা সিনেমার সেই স্বর্ণযুগের ঐতিহ্যবাহী কিছু প্রেক্ষাগৃহের কথায়।
মিত্রা সিনেমা হলের জন্ম ১৯৩১ সালে। প্রথমে এর নাম ছিল 'চিত্রা'। তৎকালীন কলকাতার মেয়র নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এর উদ্বোধন করেছিলেন। দেখানো হয়েছিল নিউ থিয়েটার্সের সবাক ছবি 'দেনা পাওনা'।হল মালিক বীরেন্দ্র নাথ সরকারকে অনুরোধ করে নেতাজী হলে শুধু বাংলা সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করেন। তারপর মালিকানা পালটে যখন জমিদার হেমন্তকৃষ্ণ মিত্র হলটি কিনে নিলেন, তখন নাম পালটে হল 'মিত্রা'।আজ তা ভেঙ্গে শপিং মল হওয়ার পথে।
১৯০৮-০৯ সালে অপেরা হাউজ হিসেবে পথ চলা শুরু করেছিল আজকের রক্সি। তখন তার নাম ছিল এম্পায়ার থিয়েটার। চল্লিশের দশকে তা সিনেমা হলে পরিণত হয়। এই প্রেক্ষাগৃহে প্রথম প্রদর্শিত ছবির নাম ‘নয়া সংসার’। ১৯৪৩ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘কিসমত’ ১৮৬ সপ্তাহ ধরে চলেছিল রক্সিতে।শোনা যায় এই ছবিই রক্সিতে বসে সেইসময় দেখেছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাসচন্দ্র বসু।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে উত্তর কলকাতায় টাউন স্কুলের পাশে একটি মাঠে তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা দেখানো শুরু করেন জে.এফ.মাডান। পরে তাঁবুর মাঠে দু’টি পাকা প্রেক্ষাগৃহও নির্মাণ করেন - কর্নওয়ালিস ও ক্রাউন।রাস্তার নামে নির্মিত‘কর্নওয়ালিস’-ই উত্তর কলকাতার প্রথম সিনেমা হল।
মাডান ১৯১৯ সালে তৈরি করেন বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফিচার ‘বিল্বমঙ্গল’ যা মুক্তি পায় কর্নওয়ালিস সিনেমাতেই।পরবর্তী কালে ‘কর্ণওয়ালিস’ ১৯৩৫ সালে হয়ে ওঠে ‘উত্তরা’ আর পাশের ক্রাউন সিনেমাহলের পরিবর্তিত নাম ‘শ্রী’। এখন সে জায়গায় জামাকাপড়ের মার্কেট। ১৯৩১-এর ২৫ এপ্রিল ক্রাউন সিনেমা হলেই মুক্তি পায় প্রথম বাংলা সবাক ছবি ‘জামাইষষ্ঠী’।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও জড়িয়ে পড়েছিলেন সিনেমার সঙ্গে। তাঁর কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এরপর রবীন্দ্রনাথ ‘নটীর পূজা’ নাম দিয়ে চিত্র পরিচালনা করার ভাবনা নিয়ে উত্তর কলকাতার একটি হলের নামকরণ করলেন রূপবাণী।১৯ শে ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সেটি উদ্বোধন করেন এবং সেই উপলক্ষে ‘রূপবাণী’ নামে একটি কবিতাও লেখেন।রূপবাণী ছিল সেকালের কলকাতার বুকে এক বিলাসবহুল প্রেক্ষাগৃহ।
দর্পণা’ সিনেমা হলটির উদ্বোধন হয়েছিল চার্লি চ্যাপলিনের ছবি ‘সিটি লাইটস’ দিয়ে। রাজ কাপুরের ‘একদিন রাত্রে’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল এখানে এবং স্বয়ং রাজ কাপুরও এসেছিলেন।

হরিপদ পাল নির্মাণ করেছিলেন মিনার চিত্রগৃহ তার আগে করেছিলেন মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতায় ছবিঘর ও বিজলী। সিনেমাপাড়ার আর এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাগৃহ রাধা সিনেমা। এখন লুপ্ত হয়ে হয়েছে বিগবাজার।

সাহিত্যিক বিমল পাল নির্মাণ করেছিলেন শো হাউস সিনেমা হল যা পরবর্তীতে হয় বিখ্যাত টকি শো হাউস।স্বয়ং সত্যজিৎ রায় এখানে বসে হলিউড মুভি দেখে গেছেন।রূপবাণীর পাশেই ছিল পূর্ণশ্রী। একমাত্র হিন্দি ছবি দেখানো হত। আরও এগিয়ে খান্না ও বিধুশ্রী, সেখানেও প্রধানত দেখানো হত হিন্দি ছবি।কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় একের পর এক বিখ্যাত সিনেমা হল যেমন এলিট, লাইট হাউস,গ্লোব, চ্যাপলিন বন্ধ হয়ে গেছে ধুঁকতে ধুঁকতে।সেই পথ নিল বিখ্যাত হল প্যারাডাইসও।১৯৩৬ এ অচ্যুত কন্যা সিনেমা দিয়ে যার উদ্বোধন হয়।উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।রাজ কাপুরও এখানে এসেছিলেন। বড় স্ক্রিন আর দারুন সাউন্ড সিস্টেমের জন্য প্যারাডাইস বিখ্যাত ছিল।এর মধ্যে মেট্রো সিনেমা হলের ভাগ্য একটু ভালো।৮৬ বছর আগে যে সিনেমা হলের সূচনা তা ১০ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সম্প্রতি মেট্রো আইনক্স রূপে মাল্টিপ্লেক্স হয়ে ফিরে এসেছে।বিখ্যাত এই হলই ছিল স্বাধীনতার পূর্বে কলকাতার অত্যাধুনিক সিনেমা হল। ১৯০৭ সালে তৈরি হয়েছিল ধর্মতলার চ্যাপলিন সিনেমা হল যা ভারতের প্রথম সিনেমা হল।বহু দেশী,বিদেশি ছবি কলকাতার দর্শকদের উপহার দিয়েছিল এই হল।এখানে একসময় নাকি প্রজেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমারের বাবা।১৯৮০ সালে ধুঁকতে থাকা এই হলকে অধিগ্রহণ করে কলকাতা পুরসভা।সংস্কার সাধন করে আবার চলতে শুরু করে হল।তবে বেশিদিন নয়।অচিরেই পড়ে যায় ঝাঁপ।বছর দশেক আগে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আজ মিশে গেছে ধূলোয়।দক্ষিণ কলকাতার আর এক গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা হল উজ্জ্বলা আজ চানাচুরের দোকান।একসময় এই হলে বহু সিনেমা হাউসফুলের রেকর্ড করেছিল।

আবার কলকাতার যে সব সিনেমা হল বিদেশী সিনেমাগুলোর প্রতি আকর্ষণের কেন্দ্র হয়েছিল তার অন্যতম ছিল এলিট।১৯১৫ সালে এর নাম ছিল প্যালেস অফ ভ্যারাইটি।১৯৩৮ এ নাম হয় এলিট।রেড রিভার সিনেমা দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়।ইতালি থেকে এনে লাগানো হয়েছিল প্রজেক্টর।প্রথমে ইংলিশ সিনেমা চললেও পড়ে হিন্দি, বাংলাও দেখানো হয়।মৃণাল সেন,সত্যজিৎ রায় প্রভৃতি বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিল এই হল।

এছাড়াও ধর্মতলার নিউএম্পায়ার,গ্লোব,টাইগার ইত্যাদি বিখ্যাত হলগুলিও বন্ধ হয়ে গেছে একে একে।
আবার শিয়ালদহের কাছে ধুঁকতে থাকা বিখ্যাত প্রাচী সিনেমা হল লড়াই ছাড়েনি। ১৯৪৮ সালে তৈরি হওয়া এই হলটির বর্তমান কর্ণধার বিদিশা বসুর হাত ধরে হলটি সাজতে চলেছে নতুন রূপে।বেঁচে থাকার জন্য এক অংশে থাকবে রিটেল আউটলেট আর অন্য অংশে আসন সংখ্যা কমিয়ে সাজানো গোছানো দুর্দান্ত সিঙ্গেল স্ক্রিন। আশা করা যায় ধুঁকতে থাকা অন্য হলগুলোও বিক্রি বা বন্ধ না হয়ে ভবিষ্যতে হয়তো প্রাচীর মডেল অনুসরণ করে বাঁচতে চাইবে।

আসলে ৬০-৭০ এর দশক থেকে ৯০ এর দশক পর্যন্ত নিম্নবিত্ত,মধ্যবিত্ত বাঙালির বিনোদনের একমাত্র মাধ্যমই ছিল প্রধানত চলচ্চিত্র।তাই কলকাতা তথা মফস্বলের অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছিল একাধিক সিনেমা হল।কলকাতার এই সব বিখ্যাত হলগুলি সেই নবজাগরণেরই অংশ।কিন্তু বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি আর হাইস্পিড ইন্টারনেটের দৌলতে নানাবিধ বিনোদনের মাধ্যম মানুষের হাতের মুঠোয়।তাছাড়া পাইরেটেড সিনেমা দেখার প্রবণতা তো আছেই। এই সবের সম্মিলিত আক্রমণেই কলকাতা তথা বাংলার এইসব নস্টালজিক হলগুলি আজ একে একে ধূলোয় মিশে যেতে বসেছে।হয়তো আগামী দিনে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যাবে সেই ঐতিহাসিক সিনেমা পাড়া।তার জায়গায় মাথা তুলবে ঝাঁ চকচকে সব মাল্টিপ্লেক্স।এরই নাম তো বিবর্তন।আর সিনেমা পাড়া বেঁচে থাকবে মধ্যবয়স্ক বাঙালি যুবক যুবতীদের হৃদয়ে এক আবেগ,এক নস্টালজিক স্মৃতি হয়ে।

Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.