প্রবন্ধ রুরু প্রমোদ্বরার প্রেমকথা
আমরা বেহুলা লক্ষিন্দরের গল্প জানি,বেহুলা কিভাবে তার স্বামীর জীবন ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল , লোহার তৈরি বাসর ঘরে কালনাগিনীর দংশনে মৃত স্বামীর শরীরকে ভেলায় চড়িয়ে নিয়ে গিয়ে অবশেষে ভগবানকে তুষ্ট করে স্বামীর প্রান পুনঃরায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল।আজ আর একজনের কথা শোনাবো। স্ত্রীকে স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ স্বামীর শরীরের অর্দ্ধ অংশ তিনি। সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মা তমোভাবাক্রান্ত হয়ে যখন রজঃ ও তমঃ গুনের মিলনে মিথুন উৎপন্ন করে তার শরীর কে দুই ভাগে ভাগ করলেন এক অর্ধাশে পুরুষ সৃষ্টি করলেন তিনিই সয়ম্ভুব মনু আর এক অর্ধাংশ নারী তিনি জগৎ মাতা শতরুপা।
শতরুপা সয়ম্ভুব মনু কে পতি রূপে বরন করে তার সাথে রমন করলেন তাই তার অপর নাম রতি। ব্রহ্মায় অর্ধনারীশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন ।তাই হয়ত নারী পুরুষের একে অপরের প্রতি মিলনের এত দুনির্বার টান। তারা একে অপরের থেকে শরীরে পৃথক হলেও মনের দিক থেকে এক হবার চেষ্টা করে তার ফলেই জগৎের সৃষ্টি।
পুরুষের হৃদয় যে নারী তার প্রিয়তমার স্থান পায় তাকে ভুলে থাকা কখনোই সম্ভব নয়। তার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত থাকে সে । মনের মিলই আসল কথা, যেখানে মনের মানুষটা না থাকল তাহলে সে জীবন অর্থহীন। এমনই একটা প্রেমের পৌরাণিক কাহিনী রুরু ও প্রমদ্বারার প্রেম কথা।
রুরু নিজের জিবনের অর্ধেক আয়ু দিয়ে প্রমোদ্বরাকে পুনঃজ্জীবিত করে তোলেন।
এই যুগেও দেখা যায় কোনো স্বামী যখন তার স্ত্রী কে বা কোনো স্ত্রী তার স্বামী কে মৃত্যু মুখ থেকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য নিজের শরীরের কোনো অঙ্গদান করে নিজের পরমায়ু কমিয়ে অপর কে বাঁচিয়ে তোলে তখন এই পৌরানিক কাহিনীগুলোর প্রাসঙিকতা বহুগুন বৃদ্ধি পায়।একে অপরের প্রতি এই নিখাদ অকৃত্তিম প্রেম ।একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের এই সংস্কার হয়ত আমাদের আদি সনাতন ধর্ম থেকেই আমরা লাভ করেছি।
রুরু প্রমোদ্বরা কে প্রচন্ড ভালোবাসতো। প্রমোদ্বরার কে ছেড়ে থাকা তার পক্ষে কখনই সম্ভব ছিল না তাই বাধ্য করেছিল স্বয়ং যমরাজ কে তার মত পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিল মৃত প্রমোদ্দ্বারকে পুনঃজ্জীবিত করতে। এবার আসা যাক মূল গল্পে।
একদিন ভোরে প্রাতঃ স্নান করে আচমন সেরে আহ্নিক ও পুজো করে রুরু ভাবল অনেক দিন তো হলো পিতার,আশ্রমে এবার একটু অরন্য ভ্রমনে যাওয়া যাক ।
রুরু কে ছিলেন? রুরু ছিলেন ব্রহ্মার প্রপৌপুত্রের পুত্র ।ব্রহ্মার পুত্র ভৃগু, ব্রহ্মার হৃদয় থেকে তার জন্ম, ভৃগুর পুত্র চ্যবন,চ্যবনের পুত্র প্রমতি। রুরুর মাতা স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচী পিতা প্রমতি।
আবার এদিকে বংশ কৌলিণ্যে প্রমোদ্বরাও কোন অংশে কম যায় না সে গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর ঔরষে স্বর্গের অপ্সরা মেনকার গর্ভজাত সন্তান।গন্ধর্ব রাজের প্রেমলীলায় আচ্ছন্ন হয়ে স্বর্গের অপ্সরা মেনকা হলেন গর্ভবতী কিন্তু স্বর্গের অপ্সরাদের তো মাতা হবার উপাই নেই। না থাকবে তাদের কোনো সংসার ধর্ম না থাকবে কোনো সন্তান। তারা চিরযৌবনা চির নবীন ও চির কুমারী তাদের কাজই হলো দেবতা দানব যক্ষ গন্ধর্ব মুনি ঋষি সহ শ্রেষ্টতর মানবজাতিকে বিনোদন প্রদান করা। রতি শাস্ত্রের চৌষট্টিকলার পারদর্শীতা দেখিয়ে জয় করতে হবে তাদের মন । শরীরী মিলন তারই এক অংশ।।গন্ধর্ব্ব রাজ বিশ্বাবসুর সাথে মিলনের ফলে মেনকা গর্ভবতী হলেন।এ তো মহা বিপদ! অগ্যতা কোন ও উপাই না দেখে মেনকা স্বর্গ থেকে নেমে এলেন মর্তে, এই ধরাতলে উপযুক্ত স্থান খোঁজার জন্য আকাশ মার্গে ভ্রমন করতে লাগলেন। তার পর এক সুন্দর নদীর ধারে পবিত্র মনোরম এক নির্জন কাননে এক ঋষির আশ্রম দেখে মেনকার খুব পছন্দ হয়ে গেলো সেই আশ্রম ছিল মহর্ষি স্থূলকেশীর আশ্রম। সেখানে পৌছে একটা নিরাপদ স্থান দেখে গোপনে গর্ভ প্রসব করলেন।এবারে মেনকার বিদায় নেবার পালা।তাকে স্বর্গে ফিরতে হবে কিন্তু চোখের জল বাধ মানছেনা মেনকার। হোক না সে স্বর্গের অপ্সরা তবুও তো মা, সদ্যজাত এই নিষ্পাপ কন্যাকে ফেলে যাওয়ার মত কঠিন কাজ তাকে করতে হবে।চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রুধারা ঝরে পরছে কিন্তু না এ ভাবে বেশীক্ষন এখানে থাকা উচিত হবে না যেকোন ও সময় কোনও আশ্রমিক সেখানে উপস্থিত হতে পারে। সে চোখের জল মুছতে মুছতে সেই তপোবনের পাশ দিয়ে বহঃমান স্রোতস্বিনী নদীর দিকে প্রস্থান করলেন।।
মহর্ষি স্থূলকেশী ছিলেন সর্ব বিদ্যা -বিশারদ,
তপর্ষি। তিনি সেই সময় তপস্যার প্রয়োজনে আশ্রমের বাইরে গিয়েছিলেন।ফেরার পথে ক্ষীণ এক কান্নার শব্দ তার কানে এলো। আশ্রমের কাছে এসে দেখলেন সদ্য প্রসূত দেবকন্যার মত এক পরমাসুন্দরী কন্যা নির্জনে অসহায়ের মত মাটিতে পড়ে আছে ও অবিরত কেঁদে চলেছে।সেই দৃশ্য দেখামাত্র তার মনের মধ্যে এক করুনার উদয় হলো তিনি তাকে পরম মমতায় সযত্নে নিজের কোলে তুলে নিয়ে আশ্রমে নিয়ে আসলেন। তারপর সেই কন্যাকে নিজের কন্যার মত লালন পালন করতে লাগলেন। তিনি তাকে স্বয়ং নিজে সমস্ত ধর্ম্ম কর্ম শেখাতে লাগলেন, সেই কন্যা সেখানে শশি কলার মত বড় হতে লাগল।
মহর্ষি স্থূলকেশী তাকে রূপে গুনে সমস্ত প্রমদাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করে তুললেন আর নাম দিলেন প্রমোদ্বরা।
এদিকে সময়ের সাথে সাথে রুরুও পিতার আশ্রমে বেড়ে উঠতে লাগল। ক্রমশ যৌবনে এসে উপস্থিত হয়েছে ।
সে দিন রুরু নিজের আশ্রম ছেড়ে ভ্রমনে বের হয়ে বন বাদার জঙ্গল ঘুরে ক্লান্ত শরীরে সেই তপোবনে এক রমনীয় আশ্রম দেখতে পেয়ে সেই দিকেই হাঁটা লাগালো। পথক্লান্ত শরীরে আশ্রমে পৌছেই দেখল এক পরমা সুন্দরী কুমারী অন্য সখীদের সাথে আপন মনে খেলা করছে। প্রমোদ্বরাকে দেখেই তার মনে তার প্রতি প্রেমের ভাব জেগে উঠল।রুরু ভাবছে কে এই অপূর্ব সুন্দর রমনী? বিধাতা যেন নিজে হাতে তাকে সৃষ্টি করেছেন রুপ লাবন্যে ভরপুর সুহাসিনী কন্যা।। প্রমোদ্বারার,দৃষ্টিও কিন্তু রুরুর উপর পড়েছে সে দূর থেকে রুরু কে দেখছে আর ভাবছে কে এই দেবতুল্য যুবক।কিন্তু সামনে যেতে সাহস পাচ্ছে না শুধু দুজনের মধ্যে চলছে অনবরত দৃষ্টি বিনিময় সেই দৃষ্টিবিনিময় ধীরে ধীরে অজান্তেই মনের ভাব বিনিময়ে ক্রমশও পরিনত হতে লাগল।
অনেকক্ষন রুরু এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর মনের ব্যাকুলতার ভাব কাঁটিয়ে ভাবল সুর্য প্রায় অস্তমিত এবার আশ্রমে ফেরা উচিত। রুরুর এবার ফেরার পালা। মন কিন্তু স্থূল কেশীর আশ্রমের দিকেই পরে আছে। ভগ্নহৃদয়ে কোনমতে নিজের আশ্রমে প্রবেশ। চোখের সামনে সর্বদা যেন প্রমোদ্বার মুখ ভেসে উঠছে। তার সেই নয়নভোলা হাসি, তার হৃদয়হরন কারী নান্দনিক চাহুনী যে চাহুনীতে তার সারা শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গিয়েছিল । রুরুর আর যেন কিছুতেই মন লাগেনা,কয়েকদিন ধরেই কেমন যেন এক উদাসীন ভাব। মনের মধ্যে সদা অস্থিরতা। তার এই করুন অবস্থা দেখে আশ্রমের বয়স্য ঋষিরা চিন্তিত তারা লক্ষ্য করেছে কয়েকদিন ধরেই রুরুর মন ভালো নেই শরীরের লালিত্যভাব আর আগের মত নেই। চোখের কোলে কাজল রেখার মত দাগ স্পষ্ট। তারা পিতৃসুলভ স্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন " হে ঋষিবর কি কারনে তোমার মনের এরুপ ব্যাকুল অবস্থা।"
রুরু মনে মনে ভাবছে সে কি তার মনের ভাব গোপন করবে নাকি সব কথা এদের খুলে বলবে।ঋষিরা অন্তঃযামী সে গোপন করলেও তপস্যার প্রভাবে তারা ঠিক জেনে নেবে, তাছাড়া সত্য বলা ছাড়া আর তো তার কোনো উপাই নেই কারন সেই তপোস্বী কন্যা কে লাভ করতে গেলে পিতার অনুমতির প্রয়োজন। আগন্তুককে কে কন্যা সম্প্রদান করবে? কিন্তু যদি সেই কন্যার পিতা রুরুর পিতৃ পরিচয় জানতে পারে। সে যে স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মার বংশজাত। এ কথা জানার পর এই ত্রিভুবনে তাকে প্রত্যাক্ষান করার দ্বিচারিতা কে দেখাবে! আর সে নিজে পিতার কাছে সেই কন্যার পাণিগ্রহনের ইচ্ছার কথা নিজে মুখে কখনোই বলতে পারবে না, তাই এই মহর্ষিরাই শ্রেও। তারাই নিঃসচয় তার মনের এই করুন অবস্থার কারন জেনে তার পিতার সম্মতি আদায় করাবে। রুরু একথা ভেবে সমস্ত বিত্তান্ত খুলে বললেন। ।আশ্রমের প্রবীন মহর্ষিরা রুরুর কাছ থেকে সব শুনে স্বিদ্ধান্ত নিলেন এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন। তারা সমবেত ভাবে গিয়ে রুরুর পিতা মহর্ষি প্রমতিকে সমস্ত ঘটনা জানালেন।মহর্ষি প্রমতি বুঝতে পারলেন যে তার পুত্র রুরু কামবাণে আক্রান্ত। সে মহর্ষি স্থূলকেশীর কন্যার প্রেমে পড়েছে।
মহর্ষি প্রমতি তার আশ্রমের অন্যান বয়স্য মহর্ষিদের সাথে নিয়ে পরের দিন প্রভাতে মহর্ষি স্থূলকেশীর কাছে উপস্থিত হলেন। তারপর মহর্ষি স্থুলকেশীর সমস্ত বিত্তান্ত জানিয়ে নিজের পুত্রের জন্য প্রমোদ্বরার পাণি পার্থনা করলেন। মহর্ষি তো প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত প্রফুল্ল, সয়ম্ভু ব্রহ্মার প্রপৌত্রের পুত্রের সাথে তার কন্যার বিবাহ হবে এ তো পরম সৌভাগ্যের কথা। তিনি তৎক্ষনাৎ সেই প্রস্তাব গ্রহন করলেন। তারপর ফল্গুনী নক্ষত্র যুক্ত এক শুভ দিন দেখে বিয়ের দিন নির্ধারিত করলেন।
রুরুর সাথে বিবাহ ঠিক হবার সংবাদ পেয়ে প্রমোদ্বারাও অত্যন্ত আনন্দিত, সেও মনে মনে রুরু কে পতি রূপে বরণ করে নিয়েছে।প্রথম দেখাতেই সে রুরুর প্রেমে পড়েছিল তার সৌম্য সুন্দর রূপ, তার তপোঃ প্রভাবের তেজ যা তার সারা শরীর দিয়ে উজ্জ্বল জ্যতিস্কের আভার মত ঝরে পরছে সেই দেখেই প্রমোদ্বরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
একদিন মনের আনন্দে প্রমোদ্বরা বনে খেলতে খেলতে এক সাপের গায়ে পা দিয়ে ফেলল। আহত সাপ ফনা তুলে ততক্ষনাৎ প্রমোদ্বরাকে দংশন করল।
প্রমোদ্বরা সেই দংশনে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।।হঠাৎ করে সেই ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তার সহচরীরাও বাক্যহারা। তার পর তাদের সম্মিত ফিরতেই প্রমোদ্বারা কে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়ল। সে মাটিতে নেতিয়ে পড়ে আছে তার চুল অবিন্যস্ত। সেই দৃশ্য দেখে মনের দুঃখে বিলাপ শুরু করে দিলো । প্রমোদ্বরা কিন্তু সাপের বিষে বিবর্ণ হয়েও আগের থেকে অনেক বেশী রমণীয় অনেক বেশি সুন্দর দেখতে লাগছিল শুধু তার চোখ গুলো ক্রমশ বুঁজে আসতে লাগল মনে হচ্ছিলো যেন সে গভীর ঘুমে মগ্ন হতে চলেছে।
এদিকে তার সহচরীরা কয়েক জন সেখানে থেকে বাকিরা দ্রুত গিয়ে আশ্রমে খবর দিল সর্বনাশ হয়ে গেছে প্রমোদবরাকে কে সাপে দংশন করেছে।সেই সংবাদ শুনে বিহবল হয়ে স্থূলকেশী অন্যান মহর্ষিদের নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসল। তার পর সেই স্থানে পৌছে দেখে প্রমোদ্বরা ভুত্বলে পড়ে আছে।
প্রমোদ্বরাকে সর্প দংশন করেছে এই সংবাদ সারা তপোভুমিতে ক্রমশ প্রচারিত হলো।তার পর অন্যান আশ্রম থেকে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন
মহর্ষি স্বস্ত্যাত্রেয়, মহর্ষি মহাজানু, মহর্ষি কুশিক,
মহর্ষি সঙ্ক্ষমেখল, মহর্ষি উদ্দালক, মহর্ষি কঠ, মহর্ষি শ্বেত, মহর্ষি ভারদ্বাজ, মহর্ষি কৌণকুৎস, মহর্ষি আষ্ট্রিষেণ, মহর্ষি গৌতম, সহ অন্যান মুনি ঋষিরা।
রুরুও প্রমোদ্বারার সর্পদংশনের সংবাদ পেয়ে পিতা মহর্ষি প্রমতি কে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছে।
প্রমোদ্বরা কে মৃত অবস্থায় দেখে সকলেই কেঁদে চলেছে।
রুরু বাক্যহারা হয়ে ভুমিতে শায়িত প্রমোদ্বরার নিষ্পান দেহের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকেই বিকার গ্রস্থের মত সেই স্থান থেকে লক্ষ্যশূন্যের মত ছুটে বের হয়ে গেল , কোথায় যাবে কি করবে কিছুই সে জানে না। প্রমোদ্বরাকে ছাড়া তার পক্ষে বেঁচে থাকাও অসম্ভব। কোন ও মতে প্রমোদ্বরাকে সে ভুলতে পারবে না।প্রিয়তমাকে এই অবস্থায় দেখে সে নিতান্ত উদভ্রান্ত । ছুটতে ছুটতে তপোবনের এক নিরলা স্থান দেখে দাঁড়ালো তারপর উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল।সেই বাঁধ ভাঙ্গা কান্নার শব্দে যেন ত্রিলোক কেঁপে উঠছে তার প্রেম তার অন্তরের ভালোবাসা, তার ক্ষোভ, অনুরাগ যেন কান্না আর চিৎকার হয়ে ঝরে পরছে।সে ব্যাকুল হয়ে প্রমোদ্বরাকে স্মরণ করতে লাগল আর বলতে লাগল।" হে ভগবান আমার এর চেয়ে দুঃখের কি আছে। আমার সুন্দরী রমনী আমার ভার্য্যা ধরা তলে পড়ে আছে। তারপর ক্ষোভের সাথে বলতে লাগল " হে ভগবান আমি যদি দান তপশ্চরণ ও গুরুজনের শুশ্রুষা করে থাকি তবে আমার প্রিয়া পুনঃ সঞ্জীবিতা হোক। আমি জন্ম থেকে আত্মসংযম ও ব্রত অনুষ্ঠান করে যে সকল পূণ্য সঞ্চয় করেছি এখন আমার প্রাণপ্রিয়া প্রমোদ্বরা সেই পূর্ণ বলে ভূমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়াক।"
তার এই গগনভেদী বিলাপ আর পার্থনা শুনে স্বয়ং দেবদূত সেখানে এসে উপস্থিত হলেন।
দেবদুত রুরু কে সান্তনা দিয়ে বললেন রুরু! তুমি দুঃখিত হয়ে যেমন প্রার্থনা করছো তা নিতান্ত অসম্ভব। যেহেতু মানুষ একবার কাল গ্রাসে পতিত হলে আর কখনোই পূনঃজ্জীবিত হয়না। এই প্রমোদ্বতা গন্ধর্বের ঔরষে অপ্সরার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। এখন তার আয়ু শেষ হয়েছে বলেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে অতএব হে বৎস তুমি আর শোক সাগরে নিমগ্ন থেকো না। "
রুরু হাত জোর করে বললেন" হে দেব দূত প্রমোদ্বরা কে ছাড়া আমার এ জীবন বৃথা। দেবতারা চাইলে সবই সম্ভব তারা চাইলে প্রমোদ্বরাকে পুনঃ,জীবিত করতে পারেন,পূর্বেও একাধিক বার এমন হয়েছে। পূর্বে দেব,দানবের যুদ্ধে দানবরা নিহত হলে দৈত্য গুরু শুক্রাচার্য সঞ্জিবনী ঔষধের মাধ্যমে তাদের পূনঃজ্জীবিত করে তুলতেন। আপনি নিশ্চয় একটা উপাই বের করুন।"
দেবদূত রুরুর কাতর আবেদন শুনে বললেন
"তবে পূর্বে দেবতাগণ এ বিষয়ে একটি উপায় নির্দেশ করেছিলেন ঠিকই। তুমি যদি তা করতে পারো তবে পুনর্বার প্রমোদ্বরাকে লাভ করতে পারবে।
দেবদূতের মুখে একথা শুনে রুরুর মুখে খুশির অভিব্যক্তি ঝড়ে পড়ল সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন "-হে দেবদূত! দেবগন এ বিষয়ে কি উপায়ে স্থির করেছেন যথার্থ করে বলুন আমি এখনই তা সম্পন্ন করব। "
দেবদূত বললেন- "হে ভৃগু নন্দন তুমি নিজের ভার্যাকে নিজের পরমায়ুর অর্ধেক প্রদান করো তাহলে সে পুনঃর্জীবিত হবে। "
রুরু তা,শুনে অত্যন্ত আহ্লাদিত, সে তার প্রিয়তমাকে আবার ফেরত পাচ্ছে তার পরিবর্তে এ ত্যাগ তো কিছুই নয়। পরম আনন্দে বললেন। যথা আজ্ঞা আমি প্রমোদ্বরাকে আমার পরমায়ু অর্ধভাগ প্রদান করলাম সে মৃত্যুশয্যা থেকে গাত্রত্থান করুক। "
তখন দেবদূত যমের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলেন "ধর্মরাজ যদি আপনি অনুমতি করেন তবে রুরুর মৃত ভার্য্যা প্রমোদ্বরা নিজের স্বামীর অর্দ্ধায়ুঃ নিয়ে পুনঃর্জীবিত হয়।"
ধর্মরাজ বললেন-হে দেবদূত যদি তোমার ইচ্ছা হয়ে থাকে তবে রুরুপত্নী রুরুর অর্দ্ধ পরমায়ুঃ পেয়ে পুনঃর্জীবিত হোক।
ধর্মরাজ এই কথা বলা মাত্র প্রমোদ্বরা রুরুর অর্ধ্ব পরমায়ু পেয়ে গেল। এবং তখনই সুপ্তোত্থিতা অবস্থায় পড়ে থাকা ধরাতল থেকে উঠে দাঁড়ালো।
এই ভাবেই প্রমদ্বরা পুনজ্জীবিত হলে রুরুর পিতা ও প্রমোদ্বরার পিতা দুজনেই আনন্দ সাগরে মগ্ন হয়ে শুভলগ্নে পুত্র-কন্যার বিবাহ সম্পন্ন করালেন। তারপর তারা পরমানন্দে সুখী গৃহস্থের মতো জীবন যাপন করতে লাগলেন।
তাদের এক সুন্দর পুত্র সন্তান হলো তার নাম হলো মহর্ষি শুনক।।রুরু প্রিয়তমাকে লাভ করে সর্প বংশ ধ্বংস করতে প্রতিজ্ঞ হলেন।
কালের হাত থেকে কারো নিস্তার নেই কিন্তু কঠোর তপস্যা কঠিন সংযম ও গভীর প্রেমের সাহায্যে তাকেও হারানো সম্ভব।
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.