গল্প ফেরা
ভদ্রমহিলার চোখমুখ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায়, সবকিছুই উনি বিশ্বাস করে নিয়েছেন। গভীর বিশ্বাস, এই বিশ্বাসের জায়গা থেকে ওঁকে বিন্দুমাত্র টলানো যাবে না। একটু আগেই উনি উত্তেজিত হয়ে আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়েছিলেন যে, আমার বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠেছিল। ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য বলে কিছু নেই, আজগুবি বলে কিছু নেই। আর, এতকাল ধরে যা-যা জেনে এসেছি, সব ভুল। তরুণ আর নির্মলও পাথর হয়ে গিয়েছিল আমার মতো, কিন্তু যত নষ্টের গোড়া অমিয় এখন ফিরে গিয়েছে টাটানগরে।
পুজোর চারদিনের ছুটিতে অমিয় এখানে এসেছিল ; আর ওর সঙ্গে এসেছিল বেঢপ, তেপায়া ছোট্ট একটা টেবিল। নিচু সেন্টার-টেবিলের ওপরে ছোট্ট ওই টেবিলটা চাপিয়ে দিয়ে অমিয় গম্ভীর ভাবে বলেছিল, ‘এই টেবিলে যে-কোনও আত্মাকে নামানো সম্ভব, তবে কিছু নিয়মকানুন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মানতে হবে।’
অমিয়কে থামিয়ে দিয়ে আমরা প্লানচেট নিয়ে হাসিঠাট্টা জুড়ে দিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে ছিল কিছু ব্যক্তিগত খোঁচাও। অমিয় হাসিমুখে সব সহ্য করেছিল। কিন্তু বুজরুকির প্রচণ্ড একটা টান আছে, বিশেষ করে হাতে সময় থাকলে। আমরা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম—এবারের পুজোর ছুটিটা স্রেফ খেয়েদেয়ে, আড্ডা মেরে, তাস খেলে কাটাব। সুতরাং মনের দিক থেকে আমরা তৈরিই ছিলাম, আমাদের পুজোর ছুটি শুরু হল প্লানচেট দিয়ে।
প্রথম দিকে অমিয়র বিস্তর ভান-ভণিতা ছিল। রাতের অন্ধকার চাই, টিমটিমে নীল আলো চাই, নির্জন পরিবেশ চাই। কঠিন পরীক্ষা দেওয়ার মতো মুখ করে নিয়মগুলো আমরা মানতে শুরু করেছিলাম প্রথম দিকে। কিন্তু প্লানচেটের টেবিলে আত্মারা এত দ্রুত আসতে শুরু করেছিল যে, খটখটে দিনের বেলাতেও আমরা টেবিল বসাতে শুরু করেছিলাম।
সম্পূর্ণ অপরিচিত আত্মাদের এমন নিকট-আত্মীয়র ব্যবহার অমিয়র খুব একটা ভালো লাগেনি, কিন্তু ব্যাপারটা মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায়ও ছিল না ওর। শুকনো মুখে বলেছিল, আকাশে অনেকগুলো স্তর আছে, বড় মাপের আত্মারা থাকে অনেক ওপরের স্তরে। সেখান থেকে এই ধুলোবালির পৃথিবীতে নেমে আসতে ওদের বেশ কষ্ট হয়। তবে রাতের অন্ধকারে, নির্জন পরিবেশে নামতে পারলে ওদের কষ্টের মাত্রা একটু কমে। এসব কথা জানাবার পরে একটু থেমে থেমে বলেছিল, ‘তোরা মিডিয়াম হিসেবে খুব ভালো, না হলে আত্মারা কক্ষনো ডাকামাত্তর আসে না।’
তিনদিনে অসংখ্য আত্মা নেমেছিল টেবিলে, সেই সঙ্গে এসেছিল রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে দিস্তের পর দিস্তে ফুলস্ক্যাপ কাগজ। আত্মারা সাধারণত বেশ বড়-বড় হরফে লেখেন। এতই বড় যে, দু-তিনটে ছোট মাপের উত্তর দেওয়ার পরেই একটা পাতা ফুরিয়ে যায়। তবে উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে সবাই বেশ চটপটে। প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর। তিনকোনা একটা বোর্ডের মধ্যিখানে গাঁথা ছিল পেনসিল, বোর্ডের তিনটে প্রান্ত তিনজনের হাতে ধরা। পেনসিল হঠাত্ নড়ে উঠলেই বোঝা যেত, যাঁকে ডাকা হয়েছে তিনি এসেছেন। তারপর শুরু হয়ে যেত প্রশ্ন, প্রশ্নের পরে প্রশ্ন। উত্তরগুলো ফুটে উঠত পেনসিলের লেখায়।
একেবারে প্রথম দিকে প্রশ্ন করা হচ্ছিল বেশ সঙ্কোচের সঙ্গে, সেই সঙ্কোচ অবশ্য বেশিক্ষণ থাকেনি। শেষের দিকে প্রশ্নের ধরন একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। মাঝেমাঝে এমন প্রশ্নও এসে যাচ্ছিল কারও-কারও মুখ থেকে, যা কোনও অচেনা মানুষকে চট করে করা যায় না। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে পেনসিল খুব দ্রুত গতিতে কাগজের ওপর ঘোরে। অমিয় আগেই শিখিয়ে দিয়েছিল, প্রশ্ন শুনে আত্মারা এমন করলে বুঝতে হবে তাঁরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তখন মাফ চেয়ে নিয়ে অন্য প্রশ্ন করতে হবে। প্রশ্ন শুনে চটে গিয়েছে এমন কিছু আত্মা আমরা আমাদের প্লানচেটের টেবিলে পেয়েছিলাম। তখন আমরা ঘটা করে মাফ চেয়ে নিতাম।
তিন দিনে এত আত্মা ডাকা হয়েছিল যে, শেষের দিকে আমরা ভুল করে কয়েকজন জীবিত লোকের আত্মাকেও ডেকে ফেলেছিলাম। তবে ভুল ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা লজ্জিত হয়ে আত্মাদের যথাস্থানেই থাকতে বলেছিলাম ভালভাবে। এই লজ্জা পাওয়াটা কিন্তু একেবারেই ইয়ার্কি-গোছের ছিল না। তিন দিনে অসংখ্য আত্মার সংস্পর্শে এসে ভেতরে ভেতরে বেশ একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম আমরা। না হলে শেষের দিকে ঘন ঘন গুরুগম্ভীর আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়তাম না।
আমাদের আলোচনার বিষয়গুলো ছিল এইরকমঃ আত্মা কী? তা কি সত্যিই অবিনশ্বর? আত্মা এমনিতে তো কোনও জীবিত মানুষের কাছে তার অস্তিত্বের প্রমাণ দেয় না। কিন্তু প্লানচেট টেবিলে বসে ডাকলে তো দিব্যি হাজির হয়। বোধহয় তিনজন মানুষের মিলিত ডাক আত্মা উপেক্ষা করতে পারে না। এমন একটা সিদ্ধান্তের জবাবে অমিয় গম্ভীর ভাবে বলেছিল, ‘সেটা অনেকখানি সত্যি, তবে সেটাই সব নয়। যে-কোনও তিনজন বসে প্লানচেট করলেই আত্মা হাজিরা দেয় না। ভালো মিডিয়াম হতে হবে, তোরা মিডিয়াম হিসেবে খুব ভালো। আত্মাদের ক্ষমতাও বিরাট। ওই যে গীতায় বলেছে না—আত্মা অবিনশ্বর। কোনও অস্ত্র একে ছিন্ন করতে পারে না, আগুন একে পোড়াতে পারে না, জল একে ভেজাতে পারে না, হাওয়া একে শুষ্ক করতে পারে না। ভালো মিডিয়ামরা প্লানচেটে বসে যদি এদের শ্রদ্ধার সঙ্গে ডাকে, আত্মারা সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারে না।’
আচমকা গীতার কথা টেনে আনায় আমরা আর আগের মতো অমিয়র সঙ্গে তর্কযুদ্ধে ঢুকতে সাহস পাইনি। কিন্তু প্লানচেটে কাগজের ওপর লেখা ফুটে ওঠে কী ভাবে? গম্ভীর আলোচনায় থই না পেয়ে আমরা এবার প্লানচেটের ওই কাঠামোটা নিয়েই পড়েছিলাম। নানারকম তর্ক-বিতর্কের শেষে আমাদের সিদ্ধান্ত হল-- চেতনের চাইতে অবচেতন ঢের বেশি শক্তিশালী। প্রথমটা যদি পঁচিশ শতাংশ হয়, শেষেরটা পঁচাত্তর। প্লানচেটে বিশ্বাস করা মানে পঁচাত্তর শতাংশ অবচেতন মনের ওপর আস্থা রাখা। শুধু আস্থা রাখা বললে সব বলা হয় না, এ একেবারে আত্মসমর্পণের সামিল। প্রশ্ন করছে বাইরের মানুষ, আর উত্তর দিচ্ছে ভেতরের মানুষ। ব্যস, নিজেদের উত্তর দেখে নিজেরাই চমকে-চমকে উঠছি।
যার-তার আত্মা নিয়ে ক্রমাগত ঘাঁটাঘাঁটি করে আমাদের এমন একটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল যে, এই সিদ্ধান্তটা আমরা মেনে নিয়েছিলাম এক কথায়। অমিয় মানেনি, একটু গাইগুঁই করার পরে দশমীর দিন টাটানগরে ফিরে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় যদি ও হতচ্ছাড়া টেবিলটা সঙ্গে নিয়ে যেত, আমি বিশ্রী এক ঝঞ্ঝাটের হাত থেকে বেঁচে যেতাম। আমার মধ্যে থেকে থেকে এমন একটা অপরাধবোধও তৈরি হত না।
ভদ্রমহিলা এলেন দশমীর দিন বিকেলে। মাইকের গান থেমে গেছে তখন, অল্প-দূরের পুজোমণ্ডপ থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে আসছিল মিহি করে। এক কাপ চা খেয়ে জানলার ধারে বেতের চেয়ার টেনে গিয়ে বসে আলসেমি করছিলাম। বাড়িতে আমি একা, এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠেছিল।
দরজা খুলতেই দেখি এক ভদ্রমহিলা, কখনো দেখেছি বলে মনে হল না। অথচ বললেন, এ পাড়াতেই আছেন বছর-দশেক ধরে। থাকেন রাস্তার মোড়ের মাথার স্টেশনারি দোকানের লাগোয়া দোতলা বাড়ির দোতলায়। ভদ্রমহিলা সঙ্কোচের সঙ্গে জানালেন আমাকে উনি চেনেন, আর এখন আমার কাছেই এসেছেন। কী যেন বলতে শুরু করেছিলেন, আমি ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বসার ঘরে নিয়ে এসে বসালাম। বসার পরে ভদ্রমহিলা একটু থেমে থেমে নিজের কথা বলে গেলেন কিছুক্ষণ ধরে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি উনি কী জন্যে এসেছেন। পরিষ্কার করে সে কথা বলতেই ভদ্রমহিলা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বললেন, ওঁর ছেলে মারা গিয়েছে।
কোথায়? কখন? আমি কেমন যেন বিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
ভদ্রমহিলা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘ আজ নয়, আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে, আজকের দিনে। দশমীর দিন ঠাকুর গেলেন, ছেলেও গেল।’
এবার আমি বিব্রত হলাম। পুত্রশোকের কথা আজকের দিনে মনে পড়ে যাওয়া হয়তো খুব স্বাভাবিক, কিন্তু এসব আমাকে জানাবার কারণ কী? ভদ্রমহিলার চেহারা, পোশাকাশাক বেশ ভালো, দেখলে তো সাহায্যপ্রার্থিনী বলে মনে হয় না। তাহলে?
ভদ্রমহিলা যখন এখানে তাঁর আসার উদ্দেশ্যর কথা জানালেন, আমি রীতিমত চমকে উঠে বলেছিলাম, ‘না-না, এসব বাজে ব্যাপার, এর মধ্যে সত্যি বলে কিছু নেই। আমরা শুধু মজা করেছি। বন্ধুরা মিলে পুজোর ছুটিটা এই ভাবেই কাটিয়েছি। কিন্তু আপনি এসব কথা জানলেন কোত্থেকে?’
উত্তরে ভদ্রমহিলা জানালেন, ‘বাড়ির পাশের স্টেশনারি দোকানের ছেলেটার কাছ থেকে জেনেছি। এ-বাড়ির কাজের লোককে দোকান থেকে বারবার অত কাগজ কিনতে দেখে ছেলেটা জিজ্ঞেস করেছিল— এত কাগজ কিনছ কেন? তার উত্তরে সে সব বলে দিয়েছে। আমি জেনেছি ওই ছেলেটার কাছ থেকে।’
শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কোথাকার জল কোথায় গড়িয়েছে ! এবার আগের চাইতেও জোরালো গলায় বললাম, ‘বিশ্বাস করুন,এটা স্রেফ খেলা। তার বেশি কিছু নয়।’
আমার কথার কোনওরকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না ভদ্রমহিলার চোখেমুখে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পরে উনি কেঁদে ফেললেন আবার। তারপর আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, ‘আমার ছেলেকে একবার অন্তত প্লানচেটে ডাকুন। কয়েকটা কথা ওর কাছ থেকে জেনে নেব আমি। ভীষণ দরকার। আমি...আমি...।’ কান্নার দমক আসায় কথাটা উনি শেষ করতে পারলেন না।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আমি আগে কখনো পড়িনি। আগের কথাটাই আবার বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম নানা ভাবে। বিশ্বাস করুন, এর মধ্যে সত্যি বলে কিছুই নেই। পুরোটাই খেলা। আমরা বেয়াড়া একটা খেলায় মেতে পুজোর ছুটির তিনটে দিন কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু উনি আমার যুক্তির ধারেকাছে যেতে চাইলেন না। বারবার ওই এক কথা—দয়া করে ছেলেকে একবারটি ডাকুন। সেই সঙ্গে কান্না।
কান্না দেখে রীতিমত অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু একই কথা বোঝাতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তেই টের পাচ্ছিলাম, একটা কথাও কানে নিচ্ছেন না উনি। থেকে থেকে ওই একটাই অনুরোধ আর কান্না। ওঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, উনি যা বলছেন, আমি বুঝি ইচ্ছে করলেই তা করতে পারি।
নিরুপায় হয়ে শেষকালে বলতে হল—‘ঠিক আছে, আপনি সন্ধে সাতটা নাগাদ আসুন। একা-একা তো আর প্লানচেট করা যায় না, আমি আমার দুই বন্ধুকে খবর দিচ্ছি।’
ভদ্রমহিলা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে যাওয়ার মুখে বললাম, ‘আর একটা কথা, আসার সময় আপনার ছেলের একটা ছবি নিয়ে আসবেন, ওটা লাগবে।’
কেন লাগবে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন না। একপাশে মাথা সামান্য হেলিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ঘর থেকে। উনি চলে যাওয়ার সময় আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, তারপর ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। মাথার ভেতরটা অসম্ভব ভার-ভার ঠেকছিল। কিছুই ভাবতে পারছিলাম না গুছিয়ে। আরও কিছুক্ষণ পরে মনে হল, অমিয়র ঢঙে ছবি আনার কথাটা না বললেই হত ! অমিয় বলেছিল, ছবি সামনে রেখে মৃত মানুষের কথা ভাবলে প্লানচেট করা সহজ হয়। তার মানে ওই ছেলেটাকে সত্যি সত্যি প্লানচেট করার কথা ভাবছি আমি।
নিজের বোকামির ওপর এত রাগ আর কখনো হয়নি আমার। মা বসে থাকবে সামনে, আর আমি তার সামনে মৃত ছেলের আত্মাকে ধরার ভান করব। নিজেকে গালাগালি দিলাম, অমিয়কে গালাগালি দিলাম, কিন্তু এখন উপায়? ঘণ্টাদুয়েক পরেই তো ভদ্রমহিলা চলে আসবেন।
নির্মল আর তরুণ এ-পাড়াতেই থাকে, ছুটলাম ওদের বাড়ি। সব শুনে আমার যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ওদেরও তাই হল। তবে ওরা আমার মতো এতখানি উদ্বিগ্ন হয়নি। না হয়ে ভালোই হয়েছে। অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হলে বুদ্ধি খেলে না মাথায়। বিচিত্র এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্যে চটপট একটা উপায় বার করে ফেলেছিল ওরা।
সাড়ে-ছটা নাগাদ আমরা আমাদের বসার ঘরে এসে বসলাম। একটু আগেই ভাসান দেওয়ার জন্যে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয়েছে মণ্ডপ থেকে। ঢাকের সেই শব্দও আর নেই। পুজোর চিত্কার-চেঁচামেচি, গান-বাজনা হঠাত্ই থেমে যাওয়ার জন্যে চারদিক অসম্ভব খাঁ-খাঁ করছিল। মৃদু শীতের হাওয়া ঢুকছিল ঘরের খোলা জানলা দিয়ে।
ঠিক সাতটার সময় ভদ্রমহিলা এলেন। এবার ওঁকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিল। শাড়ি পালটে এসেছেন, একবারের জায়গায় দুবার হয়তো চিরুনি দিয়েছেন মাথায়। বসতে বললাম। বসলেন, কিন্তু কেমন যেন আড়ষ্ট ভঙ্গিতে। ওঁর চেয়ারের পাশে আর একজনের বসার মতো জায়গা পড়েছিল। একটা হাত আঁচলের মধ্যে। ওই হাতে নির্ঘাত ছেলের ফোটোগ্রাফ আছে। ভদ্রমহিলার বয়েস চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে। সুন্দরীই বলা যায়, তবে চোখমুখের ওপরে ঝড়জলের ছাপ পড়ে গিয়েছে বেশ কিছুটা।
কী ভাবে কথা শুরু করব, বুঝতে পারছিলাম না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পরে বললাম, ‘ছবি এনেছেন?’ উনি মৃদু গলায় ‘হ্যাঁ’ বলে আঁচলের তলার হাতটা বার করলেন। হাতের মুঠোয় ব্রাউন রঙের একটা খাম। খাম থেকে ছেলের ফোটোগ্রাফ বার করে উনি আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন।
ছবিটা চোখের সামনে আনতেই আমার মুখ থেকে লম্বা একটা ই-ই-শ্ বেরিয়ে এসেছিল। ইশ্! এই ছেলেটা মারা গেছে! কত বয়েস হবে বড়জোর বছর-কুড়ি। রোগা,লম্বা ধাঁচের মুখ, মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। ছেলেটার জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকালে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না যে, ও আর নেই!
ছবিটা আমার হাত থেকে নির্মল, নির্মলের হাত থেকে তরুণের হাতে গেল।
ঘরের মধ্যে এখন কেমন যেন দমবন্ধ আবহাওয়া। মৃদু শীতের হাওয়াও গরম হয়ে উঠছিল আস্তে আস্তে। অস্বস্তি কাটাবার জন্যেই বোধহয় তরুণ কথা শুরু করেছিল। ‘কত বয়েস হয়েছিল ছেলেটার?’
‘হয়েছিল’ শব্দটা খট্ করে আমার কানে এসে লাগল।
ভদ্রমহিলা মাথা নিচু করে উত্তর দিলেন, ‘সতেরো’।
‘ও কি আপনার একমাত্র...।’
‘হ্যাঁ, একমাত্র সন্তান।’
হঠাত্ মনে হল, ঘরের হাওয়া অনেক কমে গিয়েছে। বাইরের হাওয়াও বোধহয় আর ঘরে ঢুকছে না। একটু পরে নির্মল জিজ্ঞেস করল, ‘ওর বাবা...।’
‘বাড়িতে। অসুস্থ। বছরখানেক ধরে নানারকম অসুখবিসুখে ভুগছেন।’
ঘরের ভেতরটা এবার বুঝি আরও থমথমে হয়ে উঠেছিল। এভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না, থাকা অসম্ভব। আমি একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে মুখস্থ কথা বলার ভঙ্গিতে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমরা এবার প্লানচেট করব। তবে একটা কথা, আপনার ছেলের আত্মা যদি আসে, তাকে একদম বিরক্ত করবেন না। আপনার অনুরোধেই আজ আমরা প্লানচেটে বসছি, আর কখনো এমন অনুরোধ করবেন না।’
গম্ভীর ভূমিকাটুকু শেষ করার পরে একজন জাদুকর যে ভঙ্গিতে উইংসের আড়ালে চলে যায়, আমি বোধহয় সেই ভঙ্গিতেই পর্দা ঠেলে ভেতরের ঘরে চলে গিয়েছিলাম। একটু পরে ফিরে এলাম সেই বিদ্ঘুটে তেপায়া টেবিলটা হাতে নিয়ে।
তেপায়া টেবিলটা বসালাম নিচু সেন্টার-টেবিলের ওপরে। তরুণ আর নির্মল দুটো চেয়ার টেনে এনে টেবিলের দুদিকে বসেছিল। আমি বোর্ডে বসানো সেই পেনসিল আর বড় মাপের একটা সাদা কাগজ নিয়ে এসে টেবিলের আর একদিকে বসলাম।
ভদ্রমহিলা টান হয়ে বসেছেন। ফর্সা মুখ এখন লালচে। চোখেমুখে উত্তেজনা আর কৌতূহল। আড়চোখে ওঁকে একবার দেখে নিয়ে আমি কেমন যেন পেশাদারি কায়দায় ঘরের নীল আলো জ্বেলে আর টিউব লাইটটা নিবিয়ে দিয়ে চেয়ারে ফিরে এসেছিলাম। আমাদের তিনজনের তিনটে হাত পেনসিল-লাগানো বোর্ডের তিন কোনায়। তিন জোড়া চোখ টেবিলের ওপর ফেলে-রাখা ছেলেটির ফোটোগ্রাফের দিকে তাকিয়ে। ভদ্রমহিলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঠাকুর ভাসানে চলে যাওয়ার পরে গোটা পাড়াটাই এখন অসম্ভব নিস্তব্ধ। হঠাত্ পাশের জামরুল গাছ থেকে একটা কাক ডেকে উঠল। একটা মোটে কাকের ডাক আর কখনো এত বিকট, এত কর্কশ বলে মনে হয়নি আমার।
একটু পরেই পেনসিল নড়ে উঠল। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এসেছ?’
পেনসিল টেবিলের ওপরে রাখা কাগজের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে লিখল, ‘হ্যাঁ’।
ঠাণ্ডা-গরমে মেশানো ভদ্রমহিলার লম্বা একটা নিশ্বাস আমার ঠিক কানের ওপর পড়তেই আমি কেমন যেন একটু চমকে উঠেছিলাম।
নির্মল একটু থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার মা এসেছেন, জানো?’
উত্তরে প্লানচেটের কাগজে আবার একটা বড় মাপের ‘হ্যাঁ’ ফুটে উঠল।
‘তুমি কি মাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে?’
‘না’।
‘তোমার মা কি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন?’
‘না।’
ভদ্রমহিলা সেন্টার-টেবিলের ওপর ভর দিয়ে কাগজটার ওপর ঝুঁকে পড়েছিলেন প্রায়।
তরুণ এবার প্রশ্ন করল, ‘তোমার কি এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?’
কাগজে লেখা ফুটে উঠল, ‘হ্যাঁ।’
‘যাওয়ার আগে কি কিছু বলবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী?’
‘আমি শিগ্গির আবার আসব।’
লেখাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেনসিল-লাগানো বোর্ডটা কাত হয়ে পড়েছিল কাগজের ওপর।
এখন আমার উঠে গিয়ে টিউবলাইটটা জ্বেলে দেওয়ার কথা, কিন্তু উঠতে পারলাম না। একটু পরে নির্মল বড় আলোটা জ্বেলে দিয়েছিল। জোরালো আলো দপ্ করে ছড়িয়ে গেল সারা ঘরে। ওই আলোয় ভদ্রমহিলাকে কেমন যেন অচেনা দেখাচ্ছিল। চেয়ারের একটা হাতল শক্ত করে ধরে সামান্য বেঁকে দাঁড়িয়েছিলেন উনি।
আমি বললাম, ‘আপনি বসুন না।’
ভদ্রমহিলা বসলেন না, কোনও উত্তরও দিলেন না।
‘আপনি কি চা-কফি কিছু খাবেন?’
প্রশ্নের জবাবে ভদ্রমহিলা কেমন যেন ছিটকে গিয়ে সোজা হয়ে উঠে দ্রুত মাথা ঝাঁকালেন দুপাশে। তারপর প্লানচেটের ওই কাগজটা হাতে নিয়ে কোনও দিকে না তাকিয়ে ‘চললাম’ বলে লম্বা পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আমি বেশ চটে গিয়ে তরুণকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শেষের দিকে ওই কথাটা লিখতে গেলি কেন?’
তরুণ অবাক হয়ে বলল, ‘আমি তো লিখিনি।’
‘কে লিখল তাহলে?’
‘তুই?’
‘তুই?’
‘তুই?’
ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন তিনজন তিনজনকে করেছিলাম। তিনজনেরই একই উত্তর—‘না।’
‘তাহলে!’
হতভম্ব হয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসেছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম, ভদ্রমহিলা চলে গেলে ঘরের পরিবেশ আবার আগের মতো সহজ, স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু তা হল না। আমরা এক সমস্যা থেকে আর এক সমস্যার ভেতরে গিয়ে পড়েছিলাম। শেষের ওই কথাটা কে লিখল তাহলে?
পরিকল্পনাটা অঙ্কের মতো ছকা ছিল আমাদের। এগিয়েছিও ঠিক সেই ভাবে। কে কখন কী প্রশ্ন করবে, কে তার উত্তরে কী লিখবে—সব ঠিক করা ছিল। ভদ্রমহিলাকে ফেরাবার আর কোনও উপায় ছিল না বলেই এই অভিনয়। কিন্তু কোত্থেকে ওই শেষের কথাটা এসে সব কিছু উলটোপালটা করে দিল। আমি শিগগির আবার আসব—মানে কী? কোনও মৃত মানুষের আত্মা কি এ কথা লিখতে পারে?
কথাটার নির্ঘাত মারাত্মক একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভদ্রমহিলার মনে। আমাদের এই নকল প্লানচেট আগাগোড়া সত্যি বলে ধরে নিয়েছেন উনি। এখন আমরা যদি গিয়ে বলি, ব্যাপারটা সাজানো, উনি বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু পুরোটাই কি সাজানো?
নির্মল আর তরুণের মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম, ওরা মিথ্যে কথা বলছে না। বলবেই বা কেন? এটা তো আর আমাদের ভেতরের কোনও ব্যাপার নয় যে, একজন আর একজনকে নিয়ে মজা করবে। ভদ্রমহিলার ওপর আমাদের সহানুভূতি আছে পুরো মাত্রায়। অল্পবয়সী একমাত্র ছেলেকে হারাবার কষ্ট তো মারাত্মক। পাঁচ বছরের পুরনো সেই শোকের তীব্রতা আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বেশ কিছুক্ষণ। আমাদের কারও পক্ষেই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে কোনওরকম ঠাট্টা করা সম্ভব নয়। ওই কথাটা কে লিখল তাহলে!
ঘরের বাইরে রাত বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছিল। পাড়ার ছেলেরা সেই কখন ঠাকুর ভাসান দিতে গিয়েছে, এখনও ফেরার নাম নেই। মনে হচ্ছিল, পুজোমণ্ডপে ঢাক বেজেছে দু-যুগ আগে। মাইকের গান বুঝি কতকাল শুনিনি। গোটা এলাকাটা হঠাত্ই যেন থমথমে হয়ে উঠেছিল। ঘরের ভেতরেও বেয়াড়া রকমের চুপচাপ। হাতড়ে হাতড়ে কথা বলতে বলতে আমাদের সব কথা বোধহয় ফুরিয়ে গিয়েছিল।
একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম আমরা। অনেকক্ষণ পরে পৌঁছলাম। সিদ্ধান্তটা এইরকমঃ আমরা তিনজনেই ভদ্রমহিলার দুঃখে দুঃখী। আমরা তিনজনেই চাই ভদ্রমহিলার দুঃখ ঘুচুক। কিন্তু এ দুঃখ দূর করার ক্ষমতা তো কারও নেই। মৃত সন্তান তো কখনোই বেঁচে উঠতে পারে না। তাহলে উপায়?
উপায় একটাই—মৃত সন্তান পুনর্জন্ম নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে আসুক আবার। আত্মা যদি মানা হয়, জন্মান্তর মানতেই বা দোষ কোথায়! আমাদের অবচেতন মনে নির্ঘাত এই ধরনের কোনও একটা ভাবনা তৈরি হয়েছিল। আর অবচেতন মন মানেই তো মনের বারো আনা ডুবন্ত অংশ। আমরা এখন আমাদের ভেতরের মনের ওই ছবিটা প্লানচেটের টেবিলের কাগজে ফুটে উঠতে দেখে শুধু শুধু ঘাবড়ে যাচ্ছি।
সিদ্ধান্তটা চটপট মেনে নিয়ে আমরা আবার আগের মতো সহজ, স্বাভাবিক হয়ে উঠবার চেষ্টা করতে লাগলাম। এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও করেছিলাম কিছুটা। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে তখন থেকে মাথা ঘামাচ্ছি। এর মধ্যে অলৌকিক বলে কিছু নেই। আমাদের গোপন একটা আকাঙ্ক্ষা পেনসিলের লেখায় ফুটে উঠেছে--এই যা। ইচ্ছেটা আজগুবি, কিন্তু মনের ইচ্ছে তো আর সব সময় সম্ভব-অসম্ভব মেনে তৈরি হয় না।
আমাদের যুক্তি-বুদ্ধিকে আরও কিছুক্ষণ বাহবা দিলাম আমরা। তারপর আরও কিছুটা রাত বাড়িয়ে তরুণ আর নির্মল চলে গেল। রাত বাড়তে বাড়তে বেশ কিছুটা বেড়ে যাওয়ার পরে ঠাকুর ভাসান দিয়ে পাড়ায় ফিরে এলো পাড়ার ছেলেরা। সামান্য একটু হইচই, তারপরেই সব শান্ত।
আমি কখন থেকে শুয়ে আছি তো আছিই, ঘুম আর কিছুতেই আসছে না। বিছানার পাশেই জানলা, জানলার একটু ওপরেই আকাশ। আকাশে চাঁদ-তারা কিছুই ছিল না, কিন্তু কোত্থেকে একটা ফ্যাকাশে আলো এসে ছড়িয়ে পড়েছিল আকাশের গায়ে। ওই আলোয় হঠাত্ই একটি মুখ ভেসে উঠল। একটি ছেলের মুখ। মুখটা সামান্য লম্বা ধাঁচের। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। চোখদুটো অসম্ভব জ্বলজ্বলে। এই চোখ,এই মুখ অবিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু...
এই ‘কিন্তু’টার পাশেই পড়েছিল সন্ধেবেলায় খেটেখুটে বানানো আমাদের যুক্তিগুলো। গোপন আকাঙ্ক্ষা, অবচেতন মনের জারিজুরি, কী অবলীলায় ফাঁস করে দিয়েছে এই সব যুক্তি। আমি জানি, এই যুক্তিগুলো হাতে তুলে নিলেই আকাশে ভেসে থাকা এই মুখটা মিলিয়ে যাবে এক্ষুনি। কিন্তু যুক্তিগুলো আমার ছুঁতে ইচ্ছে করছিল না একটুও। টের পাচ্ছিলাম, ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগছে যুক্তির গায়ে। হাওয়ায় কি যুক্তির বাঁধুনি আলগা হয়ে যায়, নরম হয়ে যায়?
জানি না। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, হাওয়ার সঙ্গে ধুলো উড়ে এসে ধারালো যুক্তিগুলো ঢেকে দিচ্ছে আস্তে আস্তে।
আমি জানি, এই আকাশ রাস্তার মোড়ের মাথার স্টেশনারি দোকানের লাগোয়া দোতলা বাড়ি থেকেও দেখা যাচ্ছে। আমি জানি, ওই বাড়িতে এখন এমন একজন শুয়ে আছেন যাঁর চোখের ত্রিসীমানেতেও ঘুম নেই। তিনি কি শুয়ে শুয়ে পাশের জানলা দিয়ে এই আকাশ দেখতে পাচ্ছেন? নিশ্চয়ই পাচ্ছেন। আর আকাশে চোখ গেলে ওই মুখটা চোখে পড়বেই। সামান্য লম্বা ধাঁচের মুখ, মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল, অসম্ভব জ্বলজ্বলে দুই চোখ।
আমার গভীর ভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল, এই চোখ আর এই মুখ কোনও কথা দিলে সে-কথা সে রাখবেই।
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.