গল্প পালটি
ফুটবলার
শুভম রায় বলছিলাম। বাঙালির ফুটবল যখন পুরোপুরি অবাঙালি আর আফ্রিকানদের পায়ে চলে যায়নি, আমি সেই জমানার ফুটবলার। ডার্বি ম্যাচে আমার সেই দুর্দান্ত গোল আজও অনেকের মনে আছে নিশ্চয়ই। পেনাল্টিবক্সের বাইরে নিজের গোলের দিকে মুখ করে বলটা ধরা আর স্প্লিট সেকেন্ডের মধ্যে ঘুরে গিয়ে বাঁপায়ের গোলা শটে বলটাকে জালের মধ্যে জড়িয়ে দেওয়া। উননব্বই মিনিট পর্যন্ত শূন্য-শূন্য খেলাটা ওই গোলটার দৌলতে আমাদের দিকে হেলে যায়। আর অপনেন্ট টিম এমনই বিহবল হয়ে গিয়েছিল যে ইনজুরি টাইমেও আক্রমণ শানাতেই পারল না। বল আমাদের পায়েই রইল আর শেষ বাঁশি বাজার পরপরই হাতে উঠল ডুরান্ড কাপ। প্রায় দু’বছর ক্লাব তাঁবুতে ট্রফি না ঢোকার লজ্জা খতম করে দিয়েছিল আমার ওই গোল। দিল্লির গ্যালারিতে বাঙালি ক্লাবের পতাকা পতপত করে উড়ছে, উফ, সুভাষ বোস মনে হচ্ছিল নিজেকে।
মাঠে তো একদফা জাপটাজাপটি হয়েছিল, হোটেলে ফিরতেই প্রায় লোফালুফি শুরু হল আমায় নিয়ে। তারপর একটা বালতিতে ছ’সাত বোতল বিয়ার ঢেলে সেই বালতিটা উপুড় করে দেওয়া হল আমার মাথায়।ওসব খাওয়ার অভ্যেস ছিল না তাই কপাল বেয়ে গড়িয়ে আসা বিয়ার জিভে ঠেকতেই বলে উঠেছিলাম, ‘ইস, তেতো!’। কিন্তু আজ বুঝি ওরকম মিষ্টি মুহূর্ত জীবন খুব বেশি দেয়নি আমায়।
রুমা এসেছিল রাত ন’টা নাগাদ। তখন আমি লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ভিসিআরে বচ্চনের সিনেমা দেখছি। আমার রুমমেট পলাশ তাস খেলছিল অন্য কারও ঘরে বসে, এসে বলল যে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে, আমার সঙ্গে।
বরাবরই ক্রিকেটারদের জন্য লাট্টু হত তাবড় সুন্দরীরা কিন্তু প্রায় পঁচিশবছর আগের সেই সময়টায় একটা মেয়ে কোনও ফুটবলারের খোঁজে রাত ন’টায় হোটেলে এসেছে, এটা রীতিমতো ব্রেকিং নিউজ। পলাশও উত্তেজনায় ফুটছিল খবরটা দেওয়ার সময়। আমি নিজেকে খুব নিঃস্পৃহ দেখানোর চেষ্টা করলাম তবে লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট গলাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়লাম মেঝেয়। পলাশ চেঁচিয়ে উঠল, ‘পেনাল্টি-পেনাল্টি’ বলে। আমি সেই খিল্লিকে পাত্তা না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে লিফটে ঢুকে রিসেপশনের বোতাম টিপলাম।
বেশ কিছুদিন যাবৎ গোল পাচ্ছিলাম না আমি। উঠে-নেমে খেলছিলাম, পাস পেলে শট নিচ্ছিলাম, কিন্তু কখনও পোস্টে লাগছিল সেই শট, কখনও বা গোলকিপার অবিশ্বাস্য দক্ষতায় বাঁচিয়ে দিচ্ছিল। এবার মিডফিল্ডার বা ডিফেন্ডারদের ভালো খেলার কদর হয় কিন্তু স্ট্রাইকার গোল দিতে না পারে তাহলে তার কোনও দাম নেই। কোচ থেকে কর্মকর্তা সবার কথায় টের পাচ্ছিলাম যে আমার দাম কমছে। মাঝে-মাঝে বোকা মনে হত নিজেকে। এই যে এতবছর ধরে আনুগত্য দেখালাম টিমের প্রতি,তার কি কোনও মূল্য নেই? বছরবছর দলবদল করে যারা, এবছর ঘটি তো পরেরবছরই বাঙাল, তারাই ঠিক তাহলে? এইসব ভাবনায় দুমড়ে থাকা মনটাকে একটু সোজা করব বলে হোটেল থেকে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। দিল্লি কালীবাড়িতে গিয়ে সেই মন একটু শান্ত হল। মায়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, ‘মা, সেমিফাইনালে আমাকে যখন নামিয়েছিল তখন খেলার আর পনেরো মিনিট বাকি। আজ যেন ফার্স্ট টিমে থাকি’। তারপর প্রণাম করে উঠে চরণামৃত খেয়ে অভ্যাশবশত হাত বাড়িয়ে বললাম, মায়ের পায়ের জবা দেবেন একটা?
ঠাকুরমশাই ম্লান হেসে বললেন, জবা কোথায় পাব? দিল্লিতে তো জবা পাওয়া যায় না। এই দুঃখ মনে নিয়েই মায়ের পুজো করতে হয় আমাদের।
এমন ধাক্কা খেলাম যে কথা বন্ধ হয়ে গেল প্রায়। মনে হতে থাকল, মা যেন আমার প্রার্থনা রিফিউজ করল সরাসরি। আর তখনই পিছন থেকে একটা মেয়ে বলে উঠল, আপনি জবাফুল নেবেন?
সেই মেয়েটাই রুমা। কলকাতা থেকে ওর জামাইবাবু যে দুটো জবার মালা নিয়ে এসেছিলেন, তার একটা মায়ের গলায় আমার নাম করে পরিয়ে দিলেন ঠাকুরমশাই। তারপরও আমাকে খেলা শেষ হওয়ার পনেরোমিনিট আগেই নামানো হল কিন্তু মাঠ থেকে বেরোনোর আগে যে কাজটা আমি করে এলাম তারপর আর ওই সাহস হবে না কারও। আগামী বেশ কিছুদিন। ইনফ্যাক্ট সন্ধেবেলায়ই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হোটেলে ফোন করে আমায় চাইলেন। আর আমি রিসিভারটা ধরতেই গলা নামিয়ে জানিয়ে দিলেন যে পরের মরশুমে আমিই টিম ক্যাপ্টেন হচ্ছি। সবই মায়ের কৃপা। আর সেই কৃপা যার জন্য আমার জীবনে এল, সেই রুমা, ওই তো দাঁড়িয়ে রয়েছে রিসেপশনে। আমার পা কাঁপতে শুরু করল।
রুমা হোটেল থেকে চলে যাওয়ার পরও কাঁপছিল আমার পা। যে টিমের হয়ে ট্রফি জিতে আনলাম, যার ক্যাপ্টেন হতে যাচ্ছি সেই টিম ছেড়ে যাদের গোল দিয়ে এলাম তাদের তাঁবুতে গিয়ে উঠতে হবে? এ কী চেয়ে গেল আমার থেকে রুমা?
কলকাতায় ফিরে হাজার সমর্থকের মাথায় চেপে হাওড়া স্টেশন পেরনোর সময় ভেবেছিলাম, প্রতিশ্রুতি রাখব না কিন্তু রাতে ঘুমোতে গেলেই সেই জবাফুলের মালাটা দুলত চোখের সামনে। দুলত বলেই আমি নিজের থেকে ফোন করে দল বদলাতে চেয়েছিলাম। ময়দানের ইতিহাসে ওরকম ঘটনা সেই প্রথম। আর প্রথম বলেই কীভাবে যেন জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। একদল সমর্থক কেঁদে পড়েছিল পায়ে। আর একদল ‘মীরজাফর’ বলতে শুরু করে দিল। প্রেসিডেন্ট থেকে সেক্রেটারি সবাই জানতে চেয়েছিলেন, কত বেশি পেলে থেকে যাব। কাউকে বোঝাতে পারিনি যে পৃথিবীতে তত টাকা এখনও ছাপা হয়নি যা দিয়ে ওই জবাফুলের মালাটা কেনা যায়।
পুনশ্চঃ রুমা যে ক্লাবের সাপোর্টার ছিল সেই ক্লাবের হয়েও ডার্বিতে গোল করেছি আমি। আর আমাদের বিয়েতে, জবা নয়, রজনীগন্ধার মালাই ব্যবহার হয়েছিল।
অভিনেত্রী
ছোট্ট একটা এসটিডি বুথ ছিল আমাদের। বাবাকে যখন ভিআরএস দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল তখন পিএফ’এর টাকা থেকে খোলা হয়েছিল। নয়ের দশকের শেষভাগ তখন; মোবাইল আসেনি অথচ লোকের যোগাযোগের দরকার বেড়ে গেছে। তাই অলিতে গলিতে ফোন বুথ। নামেই এসটিডি, আসলে লোকাল কলই হত বেশি। আর পাড়ার মধ্যে বলে যে পারত পয়সা বাকি রেখে যেত। তবু খারাপ চলত না আমাদের বুথটা। আর আমি বসলে একটু বেশি ভালো চলত। এটা জানত বলেই বাবা আমাকে বসতে দিতে চাইত না আর আমারও কেমন যেন জেদ চেপে যেত, বসার।কারণ পাসে বিয়ে পড়া একটা মেয়ের কাছে ওই বুথটাই ছিল নিজেকে প্রমাণ করার কুরুক্ষেত্র। মার্কশিটে দারুণ নম্বর না থাকুক, ইংরেজি বলায় ফ্লুয়েন্সি না থাকুক, আমারও এমন কিছু আছে যার জোরে মুহূর্তের মধ্যে নেহাত অদরকারে দশটা লোক ফোন করতে চলে আসে বুথে। আসলে তো আসে আমাকে দেখতে। আর ওই ফোনটা হল সেই দেখার ট্যাক্স। নিজেকে কেমন ‘গরমেন্ট’ বলে মনে হত আমার। হ্যাঁ, তাই বলতাম তখন।
সেই বলার জন্যই বকা খেয়েছিলাম সুপ্রিয়দার কাছে। বুথে একবার ঢুকলে আর বেরোতে চাইতেন না ভদ্রলোক। শুনেছিলাম, সিনেমা বানান। তখন তো দুটোমাত্র চ্যানেল আর সপ্তাহে একদিন একটা বাংলা সিনেমা, আর একদিন হিন্দি। যে শনিবার সুপ্রিয়দার ছবি দিয়েছিল, মাঝপথে কান্নার রোল উঠে গিয়েছিল পাড়ায়। কী সিনেমা রে বাবা! একটা লোক ভাঙা চৌকিতে শুয়ে কাশছে, তার বউ রাস্তার কলে বাসন মাজছে... কোনও গান নেই, ভালো সিন-সিনারি নেই, এটা সিনেমা? আমাদের পাড়ার পিছনে যে বস্তিটা সেখান দিয়ে ক্যামেরা হাতে ঘুরে এলে এরকম সিনেমা তো বিল্টু-পল্টুরাও বানাতে পারে! তাহলে ও ওইসব সোনার ময়ূর না ভাল্লুক জিতেছে কী করে? জিতেছে না ব্যাঙের মাথা! পয়সা আছে, বিদেশ থেকে কিনে এনেছে। আর এখন আমার সামনে একশো টাকার নোট বাড়িয়ে রোয়াবি দেখাচ্ছে। ‘অত ভাঙানি নেই। গরমেন্ট অত রেজগি দেয় না। আপনি ভাঙিয়ে আনুন’। মুখের ওপর বলে দিলাম আমি।
---মারব এক থাপ্পড়। ‘গভর্নমেন্ট’ বলতে পারো না? সুপ্রিয় কর ঝাঁঝিয়ে উঠল।
ওই ধমকিটা শুনেই বোধহয় লোকটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি উঠতি সুন্দরী আমার দিকে কতরকমভাবে তাকায় লোকে। কত ইয়াং ছেলে আমার একটা ইশারায় একশোবার ওঠবস করতে পারে, কত মাঝবয়সী বিচ্ছু ফোনের পয়সা দিতে এসে আমার হাত ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করে কিন্তু আমায় থাপ্পড় মারার কথা বলবে, এমন হিম্মত তো দেখিনি কারও।
হিম্মত ছিল সুপ্রিয় করের। সেই হিম্মতের ভরসায় আমাকে নায়িকা করেছিল লোকটা। তার আগে খোল-নলচে বদলে গড়ে নিয়েছিল আমাকে। এসটিডি বুথে বসা সেই মেয়েটা যখন কান কিম্বা ভেনিসের সেভেন-স্টার হোটেলের ঘরে চেক-ইন করছে, আড্ডা দিচ্ছে বিশ্বের তাবড় ফিল্ম-বোদ্ধাদের সঙ্গে তখন সত্যিই তার মনে হচ্ছিল যে সুপ্রিয় কর মানুষ নয় ভগবান। নইলে এতসব শেখাল কী করে?
আসলে সুপ্রিয়দা কিছু শেখাত না। মজ্জায় মিশিয়ে দিত। আর যেহেতু ও তখন নিজেকে মেশাতে শুরু করেছে আমার মধ্যে তাই আমি ধরতে পারতাম, ও কোথায় কী চাইছে, কতটা চাইছে। দেশের বাইরে গেলে তো বটেই, দেশের ভিতরেও যখন- যতটা সুযোগ হত, একসঙ্গে থাকতাম আমরা। রাতে একবার-দু’বার-তিনবার আমাকে খুন করত লোকটা, আর প্রতিদিন ভোরে একটা নতুন মেয়ে জন্ম নিত। সেই মেয়েটা রক্ত-মাংসে আমিই কিন্তু ভাবনায় সুপ্রিয়দার ক্লোন।
পয়সা উশুল সিনেমা থেকেও ডাক আসছিল। দুটো করলাম আর তার ভিতরে একটা হিট হওয়ায় আরও অনেকগুলো অফার এল। সুপ্রিয়দা ততক্ষণ, ‘না’ বলল না, যতক্ষণ আমি গলফ গার্ডেনের ফ্ল্যাটটা কিনে উঠতে পারলাম। তারপর সেই ফ্ল্যাটে উঠে এল বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে আর আমাকে বোঝাতে শুরু করল ক্যানিং থেকে কুচবিহার আমার জার্নি নয়, আমাকে কান থেকে কারলোভি ভ্যারি যেতে হবে। নিজেকে সুপ্রিয়দার এক্সটেনশন বলে মনে হত তাই ওর প্রতিটা কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পেতাম নিজের মধ্যে। যেসব হিরো কিম্বা প্রোডিউসার আমার দিকে ঘেঁষতে চাইত তাদের এত খেলো লাগত যে হেসে ফেলতাম গোদা রোম্যান্টিক কথাবার্তা শুনে। আমাকে তো তখন বারনার্ড শ থেকে বর্হেস পড়াচ্ছে সুপ্রিয়দা। আমাকে টের পাওয়াচ্ছে, মানুষের সমস্ত ডিজায়ারের উৎস, শরীর নয়, জ্ঞান। আপেল খেয়ে সে জানল আর জানল বলেই চাইল।কাঁচাপাকা দাড়ির বেঁটেখাটো সুপ্রিয়দার থেকে আমি ‘কী’ পাই এই প্রশ্নে তোলপাড় ইন্ডাস্ট্রির প্রত্যেককে ডেকে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করত, ‘ সেই নুড়িটা পাই যেটা নিউটন কুড়োচ্ছিলেন সমুদ্রের ধারে’।
সুপ্রিয়দার নতুন সিনেমাটায় সবদিক দিয়ে নিজেকে ছাপিয়ে গেলাম আমি। হয়তো বা বাকি সবাইকেও। রিলিজের পর একদিন দুপুরে আমাকে আদর করতে করতে সুপ্রিয়দা বলল, তোর চোখের জল ক্যামেরার লেন্স পরিষ্কার করে দিয়েছে, চিরতরে।
কথাটাকে সেলিব্রেট করব বলে আমি প্রচুর মদ খেলাম, পালটা আদর করলাম সুপ্রিয়দাকে আর তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম যখন ভাঙল তখন সন্ধে গড়িয়ে গেছে। বসার ঘর থেকে সুপ্রিয়দার গলার আওয়াজ আসছিল। বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যাওয়ার আগে খুব ইচ্ছে করল, আড়াল থেকে ওকে দেখি একবার। বেডরুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম তাই। পরদার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, সুপ্রিয়দা মোবাইলে কথা বলতে বলতে পায়চারি করছে।
---তুই আমার অনেক পুরোনো বন্ধু বলে বলছি, যেভাবে পারিস চন্দ্রমার ন্যাশনাল প্রাইজ পাওয়াটা আটকা এবারে। আমার ফিল্মটাকে প্রাইজ দে, ওকে প্রাইজ দিয়ে আমার চেয়ে বড় করে দিস না। প্লিজ...
সুপ্রিয়দার ইংরেজিতে বলা কথাগুলো নিউটনের নুড়ির মতো আছড়ে পড়ল আমার ওপর। আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
সেদিন রাতেই সুপ্রিয়দাকে বের করে দিয়েছিলাম আমার ফ্ল্যাট থেকে। আর তারপর থেকে কখনও এমন কোনও সিনেমায় সাইন করিনি যা ক্যানিং কিম্বা কুচবিহারের দর্শকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে।
পুনশ্চঃ মারকাটারি একটা কমার্শিয়াল ছবির জন্য আমি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জিতেছি গতবছর।তারপর-পরই হাতে কোনও কাজ না থাকা সুপ্রিয়দা আমায় নায়িকা করে একটা সিনেমা করতে চায়। আমি রাজি হয়ে যাই আর প্রেস-মিটের দু’ঘণ্টা আগে একটা ‘তেলুগু’ সিনেমার শুটিং উপলক্ষে হায়দ্রাবাদের প্লেন ধরি।
রাতে সুপ্রিয়দার মেসেজ পাইঃ “ চূড়ান্ত বেইজ্জত হলাম। এই চিটিংবাজিটা কেন করলে চন্দ্রমা ? এটাই কি আর্ট?”
আমি উত্তরে লিখলামঃ “ মোটেই না। আর্ট শুধু তাই যা সবচেয়ে বোকা মেয়েটাকেও কমার্শিয়াল বানিয়ে দিতে পারে”।
অধ্যাপিকা
আমি অর্চনা সেন, আজ প্রায় বাইশবছর কলেজে পড়াচ্ছি। যেরকম যা যোগ্যতা আর কানেকশন ছিল তাতে ইউনিভার্সিটিতে চলে যেতে পারতাম কিন্তু আগ্রহ দেখাইনি। গেলে অতিরিক্ত চাপ নিতে হত। তাতে আমার মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে যেত। কলেজে অনেক হালকা থাকতে পারি আর দিনের পর দিন সেই অভ্যেসটা এমন গেঁড়ে বসেছে যে কাজের কথায় গায়ে জ্বর আসে। সময়-সময় শুনি পাঁচঘণ্টা কলেজে থাকতেই হবে, বা অফ-ডে উঠে যাবে। আগে শুনতাম আর হাসতাম, এখন শুনিও না। কারণ জেনে গেছি, যাই হোক না কেন আমি আমার মতোই থাকব। আচ্ছা আমি কি স্কুল-টিচার না কেরানি যে দশটা-পাঁচটা’র দাসখতে সই করে এসেছি? গবেষণা করি বা না করি আমাকে পড়াশোনা করতে হয়। আর আমার পড়াশোনা হল মেয়েরা কে কেমন পড়াশোনা করছে সেটার ওপর নজরদারি করা। বড়টা এবার জয়েন্ট দেবে, ছোটটার মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করার দারুণ চান্স, এইসময় ঘুড়িতে ঢিল দিলেই ভোকাট্টা হয়ে যাবে ওদের কেরিয়ার। সেটা হতে দিতে পারি না আমি। কলেজ চুলোয় যাক।
চুলোয় যাবেই বা কেন? পার্টটাইমারগুলো আছে কী করতে? আমি একলাখটাকা মাইনে পেয়ে কী করছি সেটা দেখার এক্তিয়ার ওদের নেই, কিন্তু ওরা দশহাজার পেয়ে কী সারভিস দিচ্ছে সেটা বুঝে নেওয়া আমার হক। এটাই সিস্টেম। এতদিন যে সমস্ত পার্টটাইমারকে পেয়েছি সবকটাই সেই সিস্টেম মেনে নিয়েছে এককথায়, আমার ধমক-চমকের সামনে কাঁটা হয়ে থেকেছে একদম কিন্তু এই সম্বিত ছেলেটাকে নিয়ে পড়েছি মুশকিলে। প্রথম দিন থেকেই দেখছি, ভয়-ডর জিনিসটাই নেই ওর মধ্যে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ঘাড়টা নুইয়ে ফেলে না। তাও সহ্য করছিলাম কিন্তু সেদিন যখন প্রিন্সিপাল টিচার্স-রুমে আসা কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ডিপার্টমেন্টে কার ক্লাস সবচেয়ে ভালো লাগে আর সবাই একযোগে ‘সম্বিত’এর নাম বলল, আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল ।
রাতে ছটফট করতে থাকলাম বিছানায়। আমার বর ব্যাপারটা শুনে দুম করে বলে বসল, ‘ আসলে ভালোবেসে পড়ায় তো তাই...’
কাটা ঘায়ে নুনের মতো পড়ল কথাটা। হ্যাঁ, আমি এই সাবস্ট্যান্ডার্ড কলেজে পড়াতে ভালোবাসি না। যাই আর আসি কারণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটা ভালোবাসি, নিজের কেনা নতুন গাড়িটা ভালোবাসি, বেশ কয়েকজনকে সন্ত্রাসের মধ্যে বাঁচতে বাধ্য করার ক্ষমতাটা ভালোবাসি। তাই বলে, একটা ছোকরা আমার চেয়ে পপুলার হয়ে যাবে?
---চলো, দু’দিন শান্তিনিকেতন থেকে ঘুরে আসি শুধু আমরা দুজন। আমার বর বলল।
রাজি হয়ে গেলাম কারণ সামনেই গভর্নিং বডির মিটিং। আর সেখানে সম্বিতের রিনুয়াল কীভাবে আটকানো যায় তার একটা মাস্টার-প্ল্যান বানানোর জন্য একটু নিরিবিলি চাই আমার। শালার চাকরি যখন খাব তখন বুঝবে, পপুলার হওয়ার মানে।
ট্রেনের ডিমসেদ্ধ নাকি স্টেশনের সামনের ফুচকা, ঠিক কী খাওয়ার জন্য অমন ভয়ংকর ফুড-পয়জনিং হয়ে গেল, বলতে পারব না। অবিরাম বাথরুমে যেতে যেতে শরীর ছেড়ে দিল রাতের দিকটায়। আমার বর রীতিমতো ভয় পেয়ে তিন-চারটে ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে যাচ্ছিল। আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম বলে ভালো বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে হচ্ছিল, সামলে নিতে পারব ভেবে এতটা দেরি করা উচিত হয়নি। সন্ধের সময়ই কোনও লোকাল নার্সিংহোমে ভরতি হয়ে স্যালাইন নেওয়া উচিত ছিল। তারমধ্যেই আমার ফোনে অজস্র ফোন আসছিল। উফ, জিবি মিটিং’এর তো দেরি আছে এখনও!
পরদিন বেলার দিকে যখন ঘুম ভাঙল, শরীরটা খুব উইক। আর বিকেলের দিকে আমার বর একটা ‘থ্রিলার’ শোনাল আমায়। কাল রাতে নাকি সম্বিত আমায় ফোন করেছিল, চাকরি ছেড়ে দিয়েছে জানানোর জন্য। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বোলপুরে ওর বাড়ি চলে এসেছিল সম্বিত। আমি শান্তিনিকেতনে আছি আর আমার এই অবস্থা শুনে ও আমার বরকে কলকাতার ডাক্তারের বলে দেওয়া ওষুধগুলোর নাম বলতে বলে । তারপর অতরাতে বাইক চালিয়ে এই হোটেলে এসে পৌঁছে দিয়ে যায় ওষুধগুলো। আজ সকালে আবার ফোন করেছিল। একটু পরে নাকি আবার দেখতে আসছে আমায়।
পুনশ্চঃ সেদিন সম্বিতের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। ঘুমের ভান করে পড়ে ছিলাম। কিন্তু জিবি মিটিঙে কোনও আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই সম্বিতের রেজিগনেশনটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম তিন-চার টুকরো করে। আর কেউ কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগেই বলেছিলাম, ‘ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে পপুলার টিচারকে ছাড়া যায় না’।
সিডি বিক্রেতা
নতুন বাংলা-হিন্দি-ইংলিশ মুভি চাই? চলে আসবেন আমার কাছে। গড়িয়াহাটের ফুটেই আমার দোকান। যে কাউকে বলবেন, ‘বাচ্চু’র কথা, সঙ্গে-সঙ্গে দেখিয়ে দেবে। ওইসব ফিল্মের বাইরেও বিরাট একটা কালেকশন আছে আমার। সফট পরনো, হার্ড পরনো’র। মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে ঘোড়ার, এমনকি মানুষের সঙ্গে চিতাবাঘেরও একটা স্যাম্পেল জোগাড় করেছি। লাগলে বলবেন। আমার পিক-আওয়ার হল দুপুর তিনটে থেকে চারটে আর ওদিকে রাত আটটা থেকে সাড়ে-ন’টা। প্রথম দফায় কলেজ-ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা আসে আর পরের দফায় অফিস ফেরতা বাবুরা। অবাক হবেন না, বাবুদের পাশাপাশি কিছু ম্যাডামও আজকাল টুক করে একটা ‘এক্স’ চেয়ে বসেন। আর স্টুডেন্টদের মধ্যে মেয়েদের পারসেন্টেজ এখন দশে তিন। ভালোই হয়েছে। সেক্স থেকেই যখন দুনিয়া তখন ব্যাপারটা সবাই নিজের মতো করে বুঝে নিক।
মুশকিল হয় যেদিন ওই ফক্কর মেয়েটাও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে চলে আসে আমার দোকানের সামনে আর সিডি বাছতে থাকা জনতাকে এমনভাবে টুকরো-টুকরো কবিতা শোনাতে থাকে যেন কবিতাই চালাচ্ছে দুনিয়াটা। আরও মুশকিল হয় যখন একজন বয়স্ক মাস্টারমশাই গরম সহ্য করতে না পেরে বসে পড়েন ফুটেই আর ধরে তোলার সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে বসেন, বই বিক্রি করতে স্কুলে যাই না কেন আর ?
--- বই বিক্রি ছেড়ে আপনি এখন এসব নোংরামি করেন? ফাজিল মেয়েটা বলে ওঠে।
আমার ইচ্ছে হয় একটা চড় কষিয়ে দিই ওর গালে কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা যন্ত্রণা দেখতে পাই। মেয়েটা কি আমার আয়না? স্বগতোক্তি করছে আমার হয়ে? ও জানে বইয়ের জগত কীরকম?
আমি জানতাম। সেটা শুধু কলকাতা আর দুই চব্বিশ পরগনার অসংখ্য স্কুলে বই ফিরি করতাম বলে নয়, কবি-লেখকদের সঙ্গে আমার একটা খাতির ছিল বলে। ওঁরাই আমাকে একটা জায়গা দিতেন কারণ জানতেন, আমি বহু বই মার্কেটে ‘হিট’ করিয়ে দিয়েছি। অনেক কায়দা ছিল তার। যে বই দু’কপিও বিক্রি হচ্ছে না, সেই বই কোনও স্কুলের টেবিলে ফেলে যদি বলা হত, ‘ এটা কিন্তু আজ দিতে পারব না, অর্ডার আছে’, তাহলেই কেল্লাফতে। আরও চারজন আগে-পিছে না দেখেই অর্ডার করে বসতেন, বইটা। এবার সেই চার থেকে ষোল, আর কী চাই? খাজা বইয়ের ক্ষেত্রে এগুলো আমি করতাম না কিন্তু অনেক সত্যিকারের ভালো বই এভাবে পাবলিককে খাইয়ে দিয়েছি। শুধু ব্যবসার জন্য নয়, একটা অদ্ভুত স্যাটিসফ্যাকশন পেতাম।
আসলে নিজেও লিখতাম তো। তবে আমার লেখা ছিল পুরোপুরি আমার নিজেরই জন্য। কিন্তু কথাটা একজন-দু’জন কবি-সাহিত্যিকের কাছে ফাঁস হয়ে গেল। আর আশ্চর্য, যে লেখকরা একজন আরেকজনের নাম শুনলে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন তারা আমার লেখা বই হিসেবে বের করানোর জন্য জোট বেঁধে চাপ দিতে শুরু করলেন। এমন আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম যে আমার ওই তুচ্ছ কবিতাগুলো নিয়েও একটা পাণ্ডুলিপি বানিয়ে ফেললাম, ছাপিয়েও ফেললাম নিজের পয়সায়। কিন্তু কাউকে দিলাম না তখনই। মাথায় একটা প্ল্যান এল যে!
সেই প্ল্যান মোতাবেক, বর্ধমানে, আমাদের বাড়িতে একটা ছোট্ট সাহিত্যবাসরের আয়োজন করলাম আর কলকাতা থেকে নিয়ে গেলাম, আমায় ভালোবাসেন, স্নেহ করেন এমন চারজনকে। তারা কেউ কবি, কেউ ঔপন্যাসিক, কেউ বা প্রাবন্ধিক কিন্তু আমার কাছে তারা প্রত্যেকে বই- পৃথিবীর মানুষ। আমাদের বাড়ির ছাদে বসে যখন তারা নিজেদের গল্প-কবিতা পড়ছিলেন, মনে হচ্ছিল চারপাশের হাওয়া পবিত্র হয়ে যাচ্ছে। ওই ছাদেই উন্মোচিত হল আমার বই। কলকাতা থেকে আসা চারজনের হাতে চারটে বই তুলে দিয়ে প্রণাম করলাম প্রত্যেককে।
সাধ্যের বাইরে গিয়ে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করেছিলাম। শুধু কবি-সাহিত্যিকরা নন, যারা শুনতে এসেছিলেন, তাদেরও না খেয়ে যেতে দিইনি। বিশু, আমার বন্ধু, বলল, ‘ তোর বাচ্চার অন্নপ্রাশন দিচ্ছিস মনে হচ্ছে’। আমি হাসলাম, আর নিজের বইটার গায়ে একবার হাত বুলিয়ে ভাবলাম, আমারই তো বাচ্চা।
ওঁরা বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পনেরো পরে দেখলাম, একজন নিজের ক্যামেরা আর একজন কাগজপত্র সমেত একটা ফাইল ফেলে গেছেন, আমার ঘরের বিছানায়। একবার ভাবলাম কলকাতায় ফিরে দিয়ে দেব কিন্তু পরক্ষণেই মনে কাগজ-পত্রের দরকার হতে পারে। রতনদা শুনতে এসেছিল, ওকেই ম্যানেজ করলাম। রতনদার গাড়িতে চেপে যখন রওনা দিচ্ছি তখন সন্ধে নামছে।
ওঁদের ধরব বলে স্পিডে চালাচ্ছিল রতনদার ড্রাইভার কিন্তু বিধি বাম। শক্তিগড়ের কাছে সব গাড়ি আটকে আছে, সামনে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বলে। আমি গাড়ি থেকে নেমে ওঁদের ফোন করে জানলাম, সব ঠিক আছে। আর তখনই একটা ল্যাংচার দোকানের সামনে আমার সদ্যজাত বইটা চোখে পড়ল। এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিচ্ছি, দেখলাম, সামনেই আর একটা। একটু দূরে নর্দমার কাছে আরও এক কপি। প্রত্যেকটার প্রথম পৃষ্ঠায় একটু আগে আমার বাড়ি থেকে বেরোনো বরেণ্য মানুষদের নাম লেখা।
পুনশ্চঃ বর্ধমান থেকে কলকাতা যাবে বলে বেরিয়ে শক্তিগড়ের রাস্তায় পড়ে ছিল যে বই তাকে আর জনসমক্ষে আনিনি। অবৈধ বাচ্চার মতো ত্যাগ করেছি। ছেড়ে দিয়েছি বই বিক্রির ব্যবসা। বেশ করেছি। দিব্যি আছি এই সিডির জগতে। শুধু ওই ফক্কর মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, এখনও যে কপিটা কলকাতার এককামরার ঘরে তোশকের নীচে ঘুমিয়ে আছে সেটা ওর হাতে তুলে দিই। ভাবতেই ভয়ে কাঁটা দিল গা। যদি গড়িয়াহাটে উপহার পাওয়া বই যাদবপুর আসার আগেই ফেলে দেয় মেয়েটা?
ওরা চারজন
এই মুহূর্তে গড়িয়াহাটের বিরাট সেই ইলেকট্রনিক্স’এর দোকানে। শুভম আর চন্দ্রমা দোকানটার নতুন একটা সেকশন উদ্বোধন করতে এসেছেন। অর্চনা গেছেন ব্যাঙ্গালোরে পড়তে যাবে যে মেয়ে তার জন্য মাইক্রোওভেন কিনতে আর বাচ্চু এসেছে খেলার স্কোর জানতে। কিন্তু দোকানের ভিতরের সবকটা টিভিতে আজ একটাই নিউজ চ্যানেল চলছে আর সেখানে দু’জন সেলিব্রিটিকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে কেন তারা দল পালটালো। প্রচুর পাবলিক ভিড় জমিয়েছে দেখতে আর তাদের মধ্যে কেউ বলছে, ‘পয়সার জন্য’, কেউ বলছে, ‘ ধান্দা আছে’। থেকে থেকেই আওয়াজ উঠছে, ‘সুবিধাবাদী’, ‘পালটিবাজ’। হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে শব্দগুলো ওদের চারজনের কাছেও আসছে। যে চারজন প্রতিপ্রশ্নের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে আর ভাবছে, মানুষ কি সবসময় নিজের সুবিধার জন্যই পালটি খায়?
সবসময়?
Copyright © 2022 Rupkatha Live. All Rights Reserved. Powered by : Technotrick Systems.